আত্মহত্যার চেষ্টা করলে ফেসবুক কি আসলেই বুঝতে পারে?

 আত্মহত্যার চেষ্টা করলে ফেসবুক কি আসলেই বুঝতে পারে?

লাইভে এসে আত্মহত্যা করলেও ফেসবুকের অ্যালগরিদম প্রায়ই তা শনাক্তে ব্যর্থ হয়েছে। ছবি: পেক্সেলস

মূল লেখাটি প্রথম আলো অনলাইনে ২০২২ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি ‘লাইভে মহসিন আত্মহত্যা করবেন, ফেসবুক কেন বুঝল না’ শিরোনামে তৎকালীন প্রেক্ষাপটে প্রকাশিত

তুরস্কের আয়হান উজুন ফেসবুক লাইভে এসে জানিয়েছিলেন, তাঁর কন্যা বিয়ে করছেন। তবে বিয়েতে তাঁর সম্মতি নেই। ব্যাপারটা তিনি কোনোভাবেই মানতে পারছেন না। এর খানিক বাদেই সেই ভিডিওতেই পিস্তল হাতে আত্মহত্যা করতে দেখা যায় ৫৪ বছর বয়সী আয়হান উজুনকে।

এটা ২০১৭ সালের অক্টোবরের ঘটনা। একই বছরের মার্চে ফেসবুক ঘোষণা দিয়েছিল, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে তারা ফেসবুকে আত্মহত্যার প্রবণতা শনাক্ত করবে। এরপর সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে, যেন আত্মহত্যা কমিয়ে আনা সম্ভব হয়। তবে আয়হান উজুনের বেলায় তেমনটা হয়নি। উজুন বেশ কিছু সময় লাইভে ছিলেন। তিনি তাঁর হতাশা প্রকাশ করেছেন। তবু ফেসবুক তা শনাক্ত করতে পারেনি কিংবা তাৎক্ষণিক কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

সে সময় মার্কিন পত্রিকা নিউইয়র্ক পোস্টের প্রশ্নের জবাবে ফেসবুক মুখপাত্র বলেছিলেন, ‘২০০ কোটি ব্যবহারকারীর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সব লাইভ ভিডিও পর্যবেক্ষণ করা কার্যত অসম্ভব।’ বছর পাঁচেক পর এখনো সে অবস্থার খুব একটা উন্নতি হয়েছে বলে মনে হয় না। ঢাকার ব্যবসায়ী আবু মহসিন খানের আত্মহত্যার ঘটনাটি তার সাম্প্রতিক উদাহরণ। ১৬ মিনিটের বেশি সময় ধরে ফেসবুক লাইভে ব্যক্তিজীবনের হতাশার কথা বলে মাথায় গুলি করে আত্মহত্যা করেন তিনি।

এদিকে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) প্রধান অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মাহবুবুর রহমান আজ বুধবার দুপুরে বলেছেন, লাইভে যে মহসিন আত্মহত্যা করবেন, ফেসবুক তা বুঝতে পারেনি। কারণ, লাইভের শুরুতে মহসিনের কথা স্বাভাবিক ছিল বলে মনে হয়েছে তাদের কাছে। সিআইডিকে এ কথা জানিয়েছে ফেসবুক।

ফেসবুকের এ বুঝতে না পারায় অন্তত দুটি বিপর্যয় আমরা দেখেছি। প্রথমত, মহসিনের আত্মহত্যা ঠেকানোর যে সুযোগ তৈরি হতে পারত, তা হয়নি। দ্বিতীয়ত, ভিডিওটির ছড়িয়ে পড়া রোধ করা সম্ভব হয়নি।

ব্যবহারকারীদের মধ্যে আত্মহত্যা কমিয়ে আনতে ফেসবুকের উদ্যোগটি শুরুতে প্রশংসা কুড়ালেও ক্রমেই বিশেষজ্ঞরা দুশ্চিন্তায় পড়েন। তথ্যের নিরাপত্তা শঙ্কায় ইউরোপজুড়ে সে অ্যালগরিদমের প্রয়োগ দীর্ঘদিন নিষিদ্ধও ছিল। বিশেষ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ শুরুর পর থেকে শঙ্কা বাড়তে শুরু করে।

অ্যালগরিদমটি কাজ করে কীভাবে

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগের আগে অন্য ব্যবহারকারীরা কোনো পোস্ট ‘রিপোর্ট’ করলে সেটা ফেসবুকের মডারেটররা (মানব কর্মী) খতিয়ে দেখতেন। আর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালুর পর সব ব্যবহারকারীর সব ধরনের পোস্ট স্বয়ংক্রিয়ভাবে স্ক্যান করা শুরু করে সে অ্যালগরিদম। কোনো শব্দ বা ছবিতে আত্মহত্যার ঝুঁকি আছে বলে মনে হলে তা মডারেটরদের কাছে চলে যায়।

এরপর অন্য ব্যবহারকারীর রিপোর্ট থেকে কিংবা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির মাধ্যমে চিহ্নিত পোস্টগুলোর নির্বাচিত অংশ দেখে থাকেন মডারেটররা। এতে পুরোটা পড়তে বা দেখতে হয় না তাঁদের। মডারেটরদের কাছে আশঙ্কাজনক মনে হলে অবস্থান উল্লেখ করে বিষয়টি স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে জানান কিংবা ওই ব্যক্তির বন্ধু তালিকার মানুষদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করেন। এই হলো প্রক্রিয়া।

২০১৭ সালে ফেসবুকের উদ্যোগ নেওয়ার পেছনে মূল কারণ ছিল, সে সময় ফেসবুক লাইভে পরপর বেশ কটি আত্মহত্যার খবর নজরে আসে। সে ভিডিওতে আত্মহত্যাকারী মৃত্যুর আগে আত্মহত্যার কারণ জানিয়ে যান। অনেক ক্ষেত্রে আত্মহত্যার কারণ গ্রহণযোগ্য হিসেবে উপস্থাপনের সুযোগ তৈরি হয়। ভিডিওগুলো ভাইরাল হয়ে অনেক বেশি মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে।

তত দিনে সামাজিক মাধ্যমের পোস্টে উল্লেখ করা শব্দ বা ইমোজি থেকে ব্যবহারকারী আত্মহত্যার ঝুঁকিতে আছেন কি না, তা শনাক্তের উপায় বের করে ফেলেছেন গবেষকেরা। এই কৌশলগুলোকে মেশিন লার্নিং অ্যালগরিদমে রূপ দেয় ফেসবুক।

এমন আরও এক্সপ্লেইনার পড়ুন এখানে

পোস্টের কনটেন্টের পাশাপাশি অন্য ব্যবহারকারীদের কমেন্টও আমলে নেওয়া হয়। যেমন ‘সব ঠিকঠাক আছে কি না’, ‘কোনো সাহায্য লাগবে কি না’, ‘আপনি এখন কোথায়’ কিংবা এ ধরনের প্রশ্ন করলে তা চিহ্নিত করে থাকে ফেসবুকের অ্যালগরিদম।

বিশেষজ্ঞদের দুশ্চিন্তার কারণ কী

প্রথমত, আত্মহত্যা খুবই সংবেদনশীল বিষয়, মানুষের বাঁচা-মরার প্রশ্ন। দ্বিতীয়ত, অ্যালগরিদমটি ফেসবুকের প্রায় সব পোস্ট স্ক্যান করে ব্যবহারকারীর মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক তথ্য সংগ্রহ করছে। অর্থাৎ মনের খবরও ফেসবুকের সার্ভারে জমা হচ্ছে। আর বিগত বছরগুলোতে তথ্য ফাঁসের যে নজির ফেসবুক দেখিয়েছে, তাতে মনের খবর ফেসবুকের হাতে তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকার সুযোগ কই?

২০১৯ সালে বিজনেস ইনসাইডারের করা প্রশ্নের জবাবে ফেসবুক মুখপাত্র জানিয়েছিলেন, যে পোস্টগুলো মানব পর্যালোচনার প্রয়োজন নেই বলে প্রাথমিকভাবে মনে করা হয়, সেগুলোও ৩০ দিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করে রাখা হয়। কেন হয়, সে প্রশ্নের জবাব কিন্তু মেলেনি।

উপরন্তু এই মডারেটরদের অধিকাংশ চুক্তিভিত্তিক কর্মী। তাঁদের সংবেদনশীল তথ্য নিয়ে কাজের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ নেই। তাঁদের ওপর নির্ভর করে নির্ভার হওয়ার সুযোগ কম।

আমরা সিআইডিকে বলা ফেসবুকের কথায় ফিরে আসি। লাইভে যে মহসিন আত্মহত্যা করবেন, ফেসবুক তা বুঝতে পারেনি। প্রযুক্তিটি চালুর বছর পাঁচেক পর এখনো কেন স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফেসবুক শনাক্ত করতে এবং সে অনুযায়ী তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হচ্ছে, ফেসবুকের মূল প্রতিষ্ঠান মেটা প্ল্যাটফর্মসের কাছে আমরা সে প্রশ্ন রেখেছিলাম।

সরাসরি জবাব দেয়নি, তবে মেটার মুখপাত্র প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘আমাদের অ্যাপস ব্যবহারকারীদের নিরাপত্তাকে আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে থাকি। ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে আত্মহত্যা দেখানো বা এতে অন্যদের উদ্বুদ্ধ করা, দুটোই আমাদের কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড ভঙ্গ করে। উল্লিখিত আত্মহত্যার ভিডিও আমরা সরিয়ে দিয়েছি এবং আবারও কনটেন্টটি আপলোড করা থেকে বিরত রাখার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছি। আমাদের কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড ভঙ্গ করে এমন কনটেন্ট যেন আমরা আরও দ্রুত সরিয়ে ফেলতে পারি, তা নিশ্চিত করতে আমরা প্রতিনিয়ত আমাদের প্রযুক্তি উন্নত করছি। এর পাশাপাশি বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশের মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করে আমাদের নীতিমালাতেও নিয়মিত পরিবর্তন আনছি। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন মানসিক স্বাস্থ্যসহায়ক ও কাউন্সেলিং সংগঠনদের সঙ্গে যেন ব্যবহারকারীরা সহজেই যোগাযোগ করতে পারে, তা নিয়ে আমাদের নানা কার্যক্রম সব সময় চলছে।’

আরও পড়ুন: স্মার্টফোন একবার চার্জ করলে কত টাকার বিদ্যুৎ খরচ হয়

এখানে আরেকটি ব্যাপার উল্লেখ করা যেতে পারে। অ্যালগরিদমের সাহায্যে স্বয়ংক্রিয়ভাবে আত্মহত্যার প্রবণতা শনাক্তে যে প্রযুক্তি ফেসবুক ব্যবহার করে, তাতে পোস্টের কনটেন্ট বিশ্লেষণ করে দেখা হয়। ২০১৭ সালে ফেসবুকের আত্মহত্যা শনাক্তের প্রযুক্তি চালুর সময় প্রতিষ্ঠানটির ইন্টেগ্রিটি-বিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট গাই রোজেন বলেছিলেন, ‘আমাদের একটি লক্ষ্য হলো, আমাদের কর্মীরা যেন ফেসবুক-সমর্থিত যেকোনো ভাষায় বিশ্বব্যাপী সাড়া দিতে পারেন।’

তবে গত বছরের অক্টোবরে মার্কিন সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে জমা দেওয়া নথিতে ফেসবুকের সাবেক কর্মী ফ্রান্সেস হাউগেন উল্লেখ করেছিলেন, ফেসবুক ভারতে বিদ্বেষ ও সহিংসতা বন্ধে ব্যর্থ হয়েছে। কারণ, ফেসবুকের সিস্টেম হিন্দি ও বাংলা কনটেন্ট ঠিকঠাক বিশ্লেষণ করতে পারে না। আত্মহত্যার প্রবণতা শনাক্তে ব্যর্থতার পেছনে এ ধরনের কোনো কারণ আছে কি না, এমন প্রশ্নের জবার দেননি মেটা মুখপাত্র।

ভিডিও এখনো ফেসবুকে রয়েছে

আবু মহসিন খানের আত্মহত্যার ফেসবুক ভিডিও এবং ওই ঘটনার স্থিরচিত্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে অবিলম্বে অপসারণ করতে ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে (বিটিআরসি) নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। এদিকে মেটার পক্ষ থেকেও বলা হয়েছে, ‘উল্লিখিত আত্মহত্যার ভিডিও আমরা সরিয়ে দিয়েছি এবং আবারও কন্টেন্টটি আপলোড করা থেকে বিরত রাখার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছি।’ তবে গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় ফেসবুকে ভিডিওটির কপি পাওয়া গেছে।

কেবল মহসিন খানের বেলাতেই নয়, ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে বাংলাদেশিদের আত্মহত্যার আরও খবর গুগলে খুঁজলেই পাওয়া যাবে। এ ঘটনাগুলো নিয়ে ২০২০ সালের মার্চে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত জার্নাল ‘গ্লোবাল মেন্টাল হেলথ’-এ কেস স্টাডি প্রকাশ করেছিলেন তানজির রশিদ ও শেখ মোহাম্মাদ শরিফুল ইসলাম। ফেসবুক লাইভে মানুষের আত্মহত্যার কারণ কী হতে পারে, জানতে চাইলে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ তানজির রশিদ বলেন, ‘এটা বলা মুশকিল। অন্তত সব অনুভূতি ও দুঃখ-কষ্ট স্বজনদের কাছে প্রকাশ করার কার্যকর মাধ্যম বলে মনে করেন অনেকে। একই সঙ্গে সাহায্যের শেষ আবেদন। আবার যে কাজটি করছেন, তা অনেক বেশি মানুষের কাছে যৌক্তিক হিসেবে উপস্থাপনের সুযোগ করে দেয়। অনেক সময় নিজের মৃত্যুকে গ্লোরিফাই করার ফ্যান্টাসি এবং মৃত্যুর পরও মানুষ তাঁকে নিয়ে আলোচনা করবে, এমন বাসনা থাকে।’

তবে যখন আত্মহত্যার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়ে, তার নেতিবাচক প্রভাবও কম নয়।

আরও পড়ুন: আইফোনের চার্জিং কেবল দ্রুত ভেঙে যায় কেন

আরও পড়ুন

মন্তব্য করুন

Your email address will not be published.