নির্মল বায়ুর আশায় বেইজিংয়ের বদলে যাওয়ার গল্প

 নির্মল বায়ুর আশায় বেইজিংয়ের বদলে যাওয়ার গল্প

বায়ুদূষণে বেইজিংয়ের বদলে যাওয়ার চিত্র। বেইজিংয়ের জাতীয় স্টেডিয়াম বার্ডস নেস্টের আগে ও পরের ছবি

বিশ্বের দূষিত বায়ুর দেশগুলোর তালিকায় শীর্ষের দিকেই থাকে বাংলাদেশ। ২০২০ ও ২০২১ সালের সূচকে প্রথম, ২০২২-এ পঞ্চমে। আর শহরের কথা বললে, ইদানীং প্রায়ই ঢাকার অবস্থান প্রথমে দেখা যাচ্ছে। সুইজারল্যান্ডের আইকিউএয়ারের প্রতিবেদনে এমন তথ্য আমরা দেখেছি। একই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বায়ুদূষণের প্রভাবে বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর প্রায় ৭০ লাখ মানুষ মারা যায়। সেদিক থেকে বলা যায়, বাংলাদেশের মানুষ তীব্র স্বাস্থ্যঝুঁকিতে আছে।

আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক আবদুস সালাম এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, বায়ুদূষণকে নিছক পরিবেশগত ইস্যু হিসেবে দেখলে হবে না। এর সঙ্গে দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির সরাসরি সম্পর্ক আছে। কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, এতে সারা বিশ্বের কাছে আমাদের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বায়ুদূষণের কারণে অন্য দেশের মানুষ আমাদের দেশে আসতে নিরুৎসাহিত হবে। দেশে বিনিয়োগ কম হবে।

এক সময় ভাবমূর্তির এই সংকটে ছিল চীন। বেইজিংসহ দেশটির অন্যান্য শহরের বায়ুদূষণের মাত্রা আক্ষরিক অর্থেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর মতো ছিল। বায়ুদূষণের প্রভাবে আন্তর্জাতিক পর্যটক তো বটেই, এমনকি চীনের এক শহর থেকে অন্য শহরে ভ্রমণ পর্যন্ত কমতে শুরু করে।

বেইজিং অলিম্পিক থেকে শুরু

বায়ুমান নিয়ে চীনের ভাবমূর্তির সে সংকট এখনো পুরোপুরি কাটেনি ঠিক, তবে ২০০৮ সালের বেইজিং অলিম্পিক থেকে এ পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে। সে বছর চীনে বায়ুদূষণ কমিয়ে আনতে নানামুখী উদ্যোগ নেয় চীনা সরকার। কারণ আথলেটদের ওপর দূষিত বাতাসের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ পেতে শুরু করে।

নির্মল বায়ুর আশায় বেইজিংয়ের বদলে যাওয়ার গল্প
বার্ডস নেস্ট স্টেডিয়ামের সামনে। ২০০৯ সালের ছবি

অলিম্পিক শুরুর আগে উচ্চমাত্রায় দূষণকারী তিন লাখ বাহন পরিত্যাক্ত ঘোষণা করা হয়। বড় নির্মাণ কাজগুলো স্থগিত রাখা হয়। বহু কারখানা এবং বিদ্যুতকেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়া হয়।

হাতেনাতে এর ফল পেয়েছে চীন। আগের বছরের তুলনায় অলিম্পিকের সময়টাতে বায়ুর মান ৩০ শতাংশ উন্নত হয়। স্বল্পকালীন এই বিধিনিষেধেও বেইজিং ও আশপাশের শহরে হৃৎপিণ্ড এবং শ্বাসতন্ত্রের রোগে মৃত্যুহার কমে যায়।

এই সুফল অবশ্য ক্ষণস্থায়ী। অলিম্পিক শেষ হলে বিধিনিষেধ শিথিল করা হয়। এতে বায়ুর মান শিগগিরই আগের অবস্থায় ফিরে যেতে শুরু করে। তবে সে ঘটনা থেকে শিক্ষা নিতে ভুল করেনি চীন।

বায়ুদূষণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ

বছর পাঁচেক পর বায়ুদূষণ রোধে দেশব্যাপী কর্মসূচি হাতে নেয় চীন সরকার। উদ্যোগের মধ্যে ছিল দূষণমূলক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে আইন প্রণয়ন, জনবহুল এলাকা থেকে কারখানা স্থানান্তর এবং কৃষকদের প্রণোদনা।

এসব উদ্যোগে দীর্ঘমেয়াদী ফল পায় চীন। উত্তর চীনের জনবহুল শহরগুলোতে ২০১৩ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে বায়ুর মান উন্নত হয় ৩৫ শতাংশ।

উন্নতি হলেও চীনের বায়ুতে দূষিত উপাদান তখনো মাত্রাতিরিক্ত। বায়ুদূষণের জন্য দায়ী বাতাসে ভেসে বেড়ানো ২ দশমিক ৫ মাইক্রন বা আকারে তার ছোট কণা। ২০১৭ সালে চীনের প্রতি ঘনমিটার বাতাসে এমন সূক্ষ্ম কণা ছিল ৫৭ মাইক্রোগ্রাম। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রমিত মান অনুযায়ী যা ১০ মাইক্রোগ্রামের মধ্যে থাকা স্বাস্থ্যকর।

এই সময় পর্যন্ত বায়ুদূষণ রোধে তুলনামূলক সহজ উদ্যোগগুলো নিয়েছিল চীন। দূষণের হার বিবেচনায় তা আরও কমিয়ে আনতে হলে চীনের দরকার দেশটির বায়ুদূষণ সম্পর্কে বিশদ তথ্য। তারপর সে অনুযায়ী নতুন বিধিনিষেধ আরোপের বিষয়টিও আসবে।

নির্মল বায়ুর আশায় বেইজিংয়ের বদলে যাওয়ার গল্প
২০১১ সালের ছবি। বেইজিং, চীন

দরকার তথ্য, তথ্য আর তথ্য

তথ্য সংগ্রহের জন্য চীনা সরকার বায়ুমান পর্যবেক্ষণের পরিধি বাড়াতে শুরু করে। কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যোগে ২০১২ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে পর্যবেক্ষণকেন্দ্র ৬৬১ থেকে বাড়িয়ে ১ হাজার ৮০০ করা হয়। পাশাপাশি স্থানীয় প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে দেশজুড়ে হাজারো পর্যবেক্ষণকেন্দ্র তো ছিলই। এতে চীন সরকারের কাছে তথ্যের কমতি দূর হয়। তবে নতুন চ্যালেঞ্জ দেখা দেয়—কীভাবে সে তথ্য কার্যকরী উপায়ে ব্যবহার করা হবে।

বায়ুদূষণ সম্পর্কিত তথ্যের কার্যকরী ব্যবহার নিশ্চিতে চংজৌ সিটিতে পাইলট প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। শহরটির অবস্থান বেইজিং-তিয়ানজিন-হেবেই অঞ্চলে, চীনের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর অঞ্চল হিসেবে কুখ্যাতি আছে যার।

পাইলট প্রকল্পে এনভায়রনমেন্টাল ডিফেন্স ফান্ডের নেতৃত্বে জোট বাঁধে বেইজিং হুয়ান্ডিং এনভায়রনমেন্টাল বিগ ডেটা ইনস্টিটিউট ও স্থানীয় প্রশাসন। নানা উৎস থেকে বায়ুমানের তথ্য এককাট্টা করে দূষণ রোধে কোথায় কেমন পদক্ষেপ নিতে হবে, তা নির্ধারণ করা শুরু হয়। সে তুলনায় প্রকল্প শুরুর আগে অনেকটা আন্দাজের ওপর নানা জায়গায় গিয়ে বায়ুমান পরীক্ষা করতে হতো।

এখন শহরটির যেকোনো স্থানের বায়ুমানের তাৎক্ষণিক (রিয়েল-টাইম) তথ্য মানচিত্রে দেখানো হয়। অর্থাৎ মানচিত্রে চোখ রাখলে পুরো শহরের বায়ুমান একনজরে দেখে নেওয়া সম্ভব। এ কাজে স্থায়ী পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের পাশাপাশি শহরের ট্যাক্সিগুলোতে খুদে যন্ত্রাংশ জুড়ে দেওয়া হয় বায়ুমান যাচাইয়ের জন্য। এতে সহজেই গড়ে প্রতিদিন প্রায় ৫ হাজার কিলোমিটার এলাকা পর্যবেক্ষণের আওতায় রাখা সম্ভব হয়। এই যন্ত্রাংশগুলো প্রতি তিন সেকেন্ডে একবার করে তথ্য সংগ্রহ করে।

এই বিপুল পরিমাণ তথ্যের কার্যকরী ব্যবহার নিশ্চিতে ডেটা প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছে চীন। প্ল্যাটফরমটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে শনাক্ত করে কোথায় দূষণ বেশি হচ্ছে। সেই তথ্য সাধারণ অ্যাপের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেওয়া হয় স্থানীয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে।

বেইজিংয়ের তিয়েনআনমেন চত্বরে ২০১৩ সালের ছবি

দারুণ ফল মেলে। নতুন প্ল্যাটফরম চালুর তিন মাসের মধ্যে বায়ুদূষণের ‘হটস্পট’ শনাক্ত এবং সে অনুযায়ী আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সরেজমিন তদন্ত ৭০ শতাংশে উন্নিত হয়। আগের অনুমাননির্ভর পদ্ধতিতে যা ৬-৭ শতাংশের বেশি ছিল না। তদন্ত কর্মকর্তাদের কাছে এখন মাসে ৪০০-এর বেশি বায়ুদূষণ হটস্পটের খবর আসে।

বেইজিং পারলে ঢাকা পারে না কেন

২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি এ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরাম। ধরে নেওয়া যায় সে থেকে এখন পর্যন্ত প্ল্যাটফরমটি আরও উন্নত হয়েছে। চংজৌয়ের সে পাইলট প্রকল্পকে রোল মডেল মেনে চীন এবং বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে একই ধরনের প্রকল্প শুরু হতে পারে।

২০২২-এর নভেম্বরে মার্কিন পত্রিকা দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস ভারতের নয়াদিল্লির দূষিত বায়ু নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনটির ভাষ্য, বেইজিং পারলে নয়াদিল্লি পারে না কেন? দুই দেশের অর্থনীতির তারতম্য বিশাল, প্রশাসনিক কাঠামোও ভিন্ন। তবু বায়ুদূষণ রোধে বিনিয়োগের কোনো বিকল্প নেই। একই কথা প্রযোজ্য আমাদের ঢাকার ক্ষেত্রেও। এখন বরং প্রশ্ন করা যেতে পারে, বেইজিং পারলে ঢাকা পারে না কেন?

২০১৩, কিংবা তারও আগে ১৯৯৮ সালে বায়ুদূষণের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছিল বেইজিং, তাতে অনেকদূর এগিয়েছে তারা। জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির প্রতিবেদনেও তা স্পষ্ট হয়েছে আগেই। এখন সে যুদ্ধ নয়াদিল্লি, কিংবা আমাদের ঢাকার।

আরও পড়ুন: মূল্যস্ফীতি কী, কেন হয় | মূল্যস্ফীতিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি কার

    আরও পড়ুন

    মন্তব্য করুন

    Your email address will not be published.