দ্বীপে ‘নির্বাসন’ জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল

 দ্বীপে ‘নির্বাসন’ জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল

টেকসই বনায়নের প্রতি ভালোবাসা হাভিয়ের লিহোর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে

ব্যস্ততাহীন জীবন কাটাবেন বলে পানামার এক দ্বীপে ৯ একর জমি কেনেন হাভিয়ের লিহো। মন চাইলে ঘরে থাকবেন। মন চাইলে সার্ফ বোর্ডে সমুদ্রের ঢেউ কেটে এগিয়ে যাবেন।

আর্জেন্টিনায় জন্ম হাভিয়েরের। চেয়েছিলেন লাতিন আমেরিকার যানজট থেকে দূরে আরাম-আয়েশে বাকি জীবন কাটিয়ে দেবেন। সে কারণেই দ্বীপে ‘নির্বাসন’। তবে টেকসই বনায়নের প্রতি ভালোবাসা তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল।

বিবিসি বলছে, হাভিয়েরের কেনা জমিটি পানামার ক্যারিবীয় উপকূলের বাস্তিমেন্তোস দ্বীপে। আগে বন ছিল। উজাড় করেই তার কাছে বিক্রি করা হয়। হাভিয়ের চাইলেন বন ফিরিয়ে আনতে। স্থানীয়দের সঙ্গে নিয়ে এক টুকরো জমিকে সমৃদ্ধ অরণ্যে পরিণত করেন। নাম দেন ‘আপ ইন দ্য হিল’ ইকো-ফার্ম।

লাতিন আমেরিকার যানজট থেকে দূরে আরাম-আয়েশে বাকি জীবন কাটিয়ে দেবেন বলেই দ্বীপে ‘নির্বাসন’ চেয়েছিলেন হাভিয়ের

পঞ্চাশোর্ধ্ব হাভিয়ের চান তার এই উদ্যোগ যেন উদাহরণ হয়ে থাকে। যেন অন্যরাও তার মতো বনানী ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট হন।

হাভিয়ের তার জমির এক পাশে আসবাব তৈরির জন্য কাষ্ঠল উদ্ভিদ লাগিয়েছেন। আরেক অংশে চকলেটের জন্য আছে কোকোয়া গাছ। ওপরের দিকে ঔষধি গাছের বাগান আছে। বাকিটা ফলদ বৃক্ষ, শাকসবজি আর ফুলের গাছে পূর্ণ। এখানে যে পণ্য ও ফসল হয়, তা স্থানীয়ভাবেই বিক্রি করেন তিনি।

১৯৯৬ সালে কেনা জমির চেহারাই বদলে দিয়েছেন হাভিয়ের। সে সময় পারমাকালচার সম্পর্কে ধারণা ছিল তার। চাষাবাদের টেকসই এই পদ্ধতিতে রিসাইক্লিংয়ে জোর দেয়া হয়, যেন পৃথিবীর ক্ষতি কমিয়ে আনা সম্ভব হয়। একে তো কীটনাশকমুক্ত, তা ছাড়া সবকিছুই পুনর্ব্যবহারযোগ্য।

১৯৯৬ সালে কেনা জমির চেহারাই বদলে দিয়েছেন হাভিয়ের
বিশ্বজুড়ে অন্যরকম খবরগুলো দেখুন

এই পদ্ধতিতে চাষাবাদের জন্য আগে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে মূল বিষয়গুলো জানতে হয়েছে হাভিয়েরকে। কাছেই দ্বীপের আদিবাসী ‘এনগাবে বুগলে’ জনগোষ্ঠীর বেশ কিছু স্থাপনা রয়েছে।

৫৩ বছর বয়সী বেঞ্জামিন আগুইলারের সঙ্গে ২০০০ সালে দেখা হয় হাভিয়েরের। তাকে খামারে গাছ কাটার কাজে সাহায্য করতে অনুরোধ জানান হাভিয়ের। কীভাবে চাষবাস করতে হবে, কী কাজে কোন গাছ লাগাতে হবে- এসব বিষয়ে বেঞ্জামিনই পরামর্শ দেন হাভিয়েরকে।

কেবল হাভিয়ের নন, বন রক্ষায় আদিবাসীদের জ্ঞান কাজে লাগাচ্ছে পানামার স্মিথসোনিয়ান ট্রপিক্যাল রিসার্চ ইনস্টিটিউটও (এসটিআরআই)। গবেষণা ইনস্টিটিউটটির গবেষণা সহযোগী অধ্যাপক ক্যাথেরিন পটভিন পানামার আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সঙ্গে ২০ বছরের বেশি সময় ধরে কাজ করছেন। এভাবে কাজের বড় সুবিধা নিয়ে তিনি বলেন, ‘আদিবাসীরা ধনী হতে কিংবা বড় প্রতিষ্ঠান গড়ার আশায় চাষবাস করে না। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রচলিত ধারণাও তাদের নেই। তারা স্থিতিশীলতা চায়। নিজ এলাকায় দীর্ঘকাল ধরে টিকে থাকতে চায়।’

হাভিয়ের জমিটি কেনার আগে সেখানে গাছ কেটে গোচারণভূমি তৈরি করা হয়
আরও পড়ুন: আয়ারল্যান্ডে সাপ নেই কেন

আদিবাসীদের জমি ব্যবস্থাপনার পদ্ধতিও পরিবেশবান্ধব। যেমন- বনাঞ্চল অক্ষুণ্ণ রাখলে সেখানকার মাটি পানি শুষে নিতে পারে। এতে একদিকে বন্যার আশঙ্কা কমে। আবার শুষ্ক মৌসুমে খরা প্রতিরোধেও কাজ করে।

হাভিয়ের দেখলেন, নতুন করে বৃক্ষরোপণ শুরুর পর থেকে তার জমির উর্বরতা বেড়েছে। বেড়েছে জীববৈচিত্র্যও। তার জমিতে বানর, পাখি, মৌমাছি, আর্মাডিলোসহ বেশ কয়েক প্রজাতির প্রাণী ফিরেছে।

সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো স্ট্রবেরি ডার্ট প্রজাতির ব্যাঙ। নিকটবর্তী একটি দ্বীপের নামকরণ এই প্রাণীর নামেই করা হয়। তবে পর্যটন ও বন নিধন বৃদ্ধি পাওয়ায় এই প্রজাতির ব্যাঙ পরিমাণে কমেছে। হাভিয়ের বলেন, ‘তিন বছরের বেশি সময় ধরে আমরা কখনোই ব্যাঙ দেখিনি। অথচ এখন তারা সব জায়গায়।’

হাভিয়েরের কেনা জমিতে উপযুক্ত পরিবেশ ফিরে পেয়ে হারিয়ে যাওয়া প্রাণীগুলো ফিরতে শুরু করেছে
হাভিয়েরের কেনা জমিতে উপযুক্ত পরিবেশ ফিরে পেয়ে হারিয়ে যাওয়া প্রাণীগুলো ফিরতে শুরু করেছে

হাভিয়েরের কাজটি ছোট পরিসরে হলেও তাকে অনুসরণ করে পানামার অন্য অঞ্চলে একই ধরনের প্রকল্প চালু আছে। যেমন বন্যার কবল থেকে পানাম খাল রক্ষায় পুনর্বনায়ন প্রকল্পে নেতৃত্ব দেন এসটিআরআইয়ের বিজ্ঞানী জেফারসন হল। আবার গত অক্টোবরে এনগাবে-বুগলে জনগোষ্ঠীর সঙ্গে একটি চুক্তি করে এসটিআরআই। তাদের সঙ্গে নিয়ে ওই এলাকায় পুনর্বনায়ন প্রকল্প পরিচালনা এর উদ্দেশ্য।

আরও পড়ুন: মহাকাশে ঢেকুর তোলা যায় না কেন?

জেফারসন হল বলেন, ‘দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্কের শুরুতে আমরা। আমাদের শেখার কেবল শুরু। বৃক্ষরোপণে মানুষ কতটা উদ্যমী হতে পারে, তা দেখে আমরা অভিভূত হয়েছি, তবে অবাক হইনি।’

হাভিয়েরের প্রকল্পটি ছোট হতে পারে। তবে পৃথিবীকে বাসযোগ্য রাখতে ছোট উদ্যোগও যে সহায়ক, তার বড় প্রমাণ।

আরও পড়ুন

মন্তব্য করুন

Your email address will not be published.