পাইয়ের মান জেনে কার কী লাভ
গাণিতিক ধ্রুবক ‘পাই’-এর মান নির্ণয়ে একের পর এক নতুন রেকর্ড গড়ছেন বিজ্ঞানীরা। যেমন সুপার কম্পিউটারের সাহায্যে ২০২১ সালের আগস্টে ১০৮ দিন ৯ ঘণ্টা ব্যয়ে ৬২ লাখ ৮০ হাজার কোটি ঘর পর্যন্ত নির্ভুল মান বের করা সম্ভব হয়। এমন রেকর্ডের খবর মাঝেমধ্যেই আসে। তবে প্রশ্ন হলো, পাইয়ের মান জেনে আমাদের লাভ কী? চলুন সে প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করা যাক।
শুরুতেই বলি, পাইয়ের মান আমাদের কী কাজে লাগে, তা গণিতবিদদের আলোচনার বিষয়। আমরা আমাদের আলোচনা প্রযুক্তিতে সীমিত রাখতে চাই। আমাদের প্রশ্ন মূলত, এই যে একের পর এক পাইয়ের দীর্ঘতম মান বের করার চেষ্টা হচ্ছে, তা কেন?
এমন প্রশ্ন করার কারণ হলো, মহাজাগতিক হিসাব–নিকাশেও পাইয়ের মান ৪০ ঘরের বেশি প্রয়োজন হয় না। মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসাও গ্রহ-নক্ষত্রের হিসাবে বড়জোর ১৫ ঘর পর্যন্ত ব্যবহার করে। সেখানে নতুন রেকর্ডে আছে ৬২ লাখ ৮০ হাজার কোটি ঘর পর্যন্ত নির্ভুল মান। সংখ্যাটি ৬২৮ লিখে টানা ১১টি শূন্য।
বৃত্তের পরিধি ও ব্যাসের অনুপাত প্রকাশ করা হয় পাইয়ের মাধ্যমে। ধ্রুবকটির মানের প্রথম ১০টি ডিজিট হলো ৩.১৪১৫৯২৬৫৩। পাইকে রহস্যময় বলা হয়, কারণ এর নিখুঁত মান নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। গবেষকেরা অবশ্য তাতে আশাহত হননি। একের চেয়ে এক শক্তিশালী সুপার কম্পিউটার ব্যবহারে মান নির্ণয়ের চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
সে চেষ্টা কতদিনের?
নিউজউইকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আমাদের জানামতে পাইয়ের প্রথম আনুমানিক মান বের করা হয় প্রায় চার হাজার বছর আগে, প্রাচীন মিসর ও ব্যাবিলনীয়ায়।
খ্রিষ্টপূর্ব ২৫০ সালের দিকে গ্রিক গণিতবিদ আর্কিমিডিস জ্যামিতিক অ্যালগোরিদমের সাহায্যে পাইয়ের মান নির্ণয়ের পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। এর পরের উদ্ভাবিত পদ্ধতিগুলোও অ্যালগোরিদম-নির্ভর।
পাইয়ের দীর্ঘতম মান বের করার সাম্প্রতিক চেষ্টাগুলো করা হয় কম্পিউটারে। চলুন দেখে নেওয়া যাক তেমন কিছু মাইলফলক—
- ১৯৪৯ সালে ৭০ ঘণ্টায় পাইয়ের ২ হাজার ৩৭ ঘর পর্যন্ত মান বের করা হয় এনিয়াক কম্পিউটারে।
- ১৯৫৯ সালে আইবিএম ৭০৪ কম্পিউটারে ৪ ঘণ্টা ২০ মিনিটে ১৬ হাজার ১৫৭ ঘর পর্যন্ত পাইয়ের মান পাওয়া যায়।
- ১৯৬২ সালে ম্যাথমেটিকস অব কম্পিউটেশন জার্নালে প্রকাশিত গবেষণাপত্রে ডেনিয়েল শ্যাঙ্কস এবং জন রেঞ্চ জুনিয়র দেখালেন, আইবিএম ৭০৪ কম্পিউটারে যদি ৩৮ হাজার শব্দের বেশি মেমোরি (সে সময় মেমোরির হিসাব ছিল এমন) থাকত, তবে ১৬৭ ঘণ্টায় এক লাখতম ঘর পর্যন্ত পাইয়ের মান বের করা সম্ভব হতো। তবে কম্পিউটারটির সে সক্ষমতা ছিল না।
- ১৯৬১ সালে আইবিএম ৭০৯০ কম্পিউটারে ৮ ঘণ্টা ৪৩ মিনিটে এক লাখতম ঘরে পৌঁছানো সম্ভব হয়।
- ১০০ কোটিতম ঘর পর্যন্ত পাইয়ের মান বের করা সম্ভব হয় ১৯৮৯ সালে। ১৯৯৯ সাল নাগাদ সেটি ২০ হাজার কোটিতম ঘরে পৌঁছায়। আর ২০০৫ সালে পৌঁছায় ১ লাখ ২৪ হাজার কোটিতম ঘরে।
- পাইয়ের মান নির্ণয়ের বর্তমানের আগের বিশ্ব রেকর্ডে ৫০ লাখ কোটি ঘর পর্যন্ত মান পাওয়া গিয়েছিল, সেটি গত বছর।
- আর ২০২১-এর আগস্টের রেকর্ডে পাওয়া যায় ৬২ লাখ ৮০ হাজার কোটি ঘর পর্যন্ত নিখুঁত মান। এই মান নির্ণয়ে সুপার কম্পিউটারের লেগেছে ১০৮ দিন ৯ ঘণ্টা।
ইতিহাস দেখিয়ে মাথা ভারী করার কোনো উদ্দেশ্য ছিল না এখানে। তবে আপনি যদি ১৯৪৯ সালের এনিয়াক থেকে ২০২১ সালের রেকর্ড পর্যন্ত একটা কাল্পনিক সময়রেখা তৈরির চেষ্টা করেন, তবে কম্পিউটার-প্রযুক্তির অগ্রগতির চিত্র পাবেন।
আগেই বলা হয়েছে, বৃত্তের পরিধি ও ব্যাসের অনুপাত প্রকাশ করে পাই। সেটা চার হাজার বছর আগে যা ছিল, এখনো তা-ই আছে। আমরা কেবল নতুন কম্পিউটার, নতুন প্রযুক্তির সাহায্যে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ঘর পর্যন্ত মান বের করতে পারছি।
একবাক্যে বললে, পাইয়ের মান নির্ণয়ের নতুন নতুন রেকর্ড কম্পিউটারের সক্ষমতা প্রমাণ করে। কিংবা আধুনিক কম্পিউটারের ক্ষমতার শেষ সীমা অবধি পরীক্ষার সুযোগ করে দেয় আমাদের। পাইয়ের এত দীর্ঘ মান গাণিতিক সমীকরণে কিন্তু প্রয়োজন নেই।
পাইয়ের দীর্ঘতম মান নির্ণয়ের বিশ্ব রেকর্ড গড়ার ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা বলেছেন, এ থেকে যে অভিজ্ঞতা অর্জিত হলো, তা আরএনএ বিশ্লেষণ, ডিপ লার্নিং বা ফ্লুইড ডাইনামিকস সিমুলেশনের মতো অন্যান্য ক্ষেত্রে কাজে লাগানো যেতে পারে। অর্থাৎ, পাইয়ের মান বের করা তাঁদের মূল উদ্দেশ্য ছিল না।
মূল গবেষক টমাস কেলারও একই কথা বলেছেন। লাইভ সায়েন্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘রেকর্ড ভাঙাটা মূলত গবেষণা ও উন্নয়নমূলক কাজে ব্যবহারের জন্য আমাদের হাই পারফরম্যান্স কম্পিউটার তৈরির “পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া” ছিল।’
শেষ করার আগে একটি তথ্য দেওয়া যাক। ৬২ দশমিক ৮ ট্রিলিয়ন ঘর পর্যন্ত পাইয়ের মান বের করতে যে কম্পিউটার ব্যবহার করা হয়েছে, তাতে প্রায় ৩১৬ টেরাবাইট র্যাম ছিল।
বলুন তো, এই পরিমাণ র্যাম আপনার পার্সোনাল কম্পিউটারের র্যামের কত গুণ?