চ্যাটজিপিটি কেন মানুষের সমকক্ষ হতে পারেনি
যন্ত্র কি মানুষের মতো বুদ্ধিমান? এখনো না। তবে আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স (এআই) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি যেভাবে এগোচ্ছে, তাতে একদিন যন্ত্রও মানুষের মতো ভাবতে এবং সে অনুযায়ী কাজ করতে পারবে বলে মনে করা হয়।
অবশ্য চ্যাটজিপিটির মতো অ্যাপ্লিকেশনগুলো এরই মধ্যে মানুষের সমকক্ষ হয়ে উঠছে বলে মানেন অনেকে। সে কথা কিছুটা ঠিক। মানুষ করতে পারে এমন অনেক কাজ চ্যাটজিপিটির কাছে নস্যি। তবে মানুষের বিকল্প হয়ে ওঠেনি। কেন ওঠেনি, সেটাই আজ আলোচ্য।
আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স কম্পিউটার বিজ্ঞানের একটি বিশদ শাখা। মানুষের মতো কাজ করতে পারা বুদ্ধিমান যন্ত্র তৈরি যেটার কাজ। কতখানি মানুষের মতো কাজ করতে পারে বা পারবে, সেটার ওপর নির্ভর করে আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্সকে নানাভাবে শ্রেণিভুক্ত করা যায়। তিনটি মূল শ্রেণি হলো—
- আর্টিফিশিয়াল ন্যারো ইনটেলিজেন্স (ন্যারো এআই)
- আর্টিফিশিয়াল জেনারেল ইনটেলিজেন্স (জেনারেল এআই)
- আর্টিফিশিয়াল সুপার ইনটেলিজেন্স (সুপার এআই)
কোন এআইয়ের কী কাজ
সুনির্দিষ্ট কাজের জন্য তৈরি এআই প্রোগ্রামকে আর্টিফিশিয়াল ন্যারো ইনটেলিজেন্স (ন্যারো এআই) বলে। বিকল্প নাম ‘উইক এআই’ হলেও প্রযুক্তিটি যথেষ্ট উন্নত এবং আধুনিক সব ধরনের এআই সিস্টেম এই শ্রেণিতে পড়ে। সেটা হতে পারে ছবি বা চেহারা শনাক্তের প্রযুক্তি, চ্যাটজিপিটির মতো কথোপকথন চালিয়ে নেওয়ার চ্যাটবট কিংবা টেসলার মতো সেলফ-ড্রাইভিং বা স্বচালিত গাড়ি। যে কাজের জন্য তৈরি, সেটা ছাড়া আর কিছু করতে পারে না বলেই এটার নাম আর্টিফিশিয়াল ‘ন্যারো’ ইনটেলিজেন্স।
অন্যদিকে আর্টিফিশিয়াল জেনারেল ইনটেলিজেন্স (জেনারেল এআই) অনেকটা মানুষের মতোই দক্ষ। মানুষ যেভাবে শিখে নিয়ে কাজ করতে পারে, জেনারেল এআই সিস্টেমও সেভাবেই কাজ করবে। অনেক গবেষক আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্সের শ্রেণিবিভাগ করতে চান না। তাদের মতে, এআই মানেই জেনারেল এআই। সেটাই নিয়তি। অর্জন এখনো সম্ভব হয়ে ওঠেনি ঠিক, তবে সে পথেই কাজ চলছে।
আর আর্টিফিশিয়াল সুপারইনটেলিজেন্স (সুপার এআই) সবদিক থেকে মানুষকে ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করা হয়। একদল বুদ্ধিমান রোবট মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে বসবে বলে যেসব কল্পকাহিনী প্রচলিত আছে, তা আদৌ সম্ভব হলে এই পর্যায়ে হবে। সে অনেক পরের কথা। সেদিকে আপাতত যাচ্ছি না। আমাদের আলোচনা আর্টিফিশিয়াল জেনারেল ইনটেলিজেন্সকে কেন্দ্রে রেখেই।
ন্যারো এআই কাজ করে পূর্বনির্ধারিত প্রক্রিয়া কিংবা অ্যালগরিদম মেনে। অন্যদিকে জেনারেল এআই কাজ করে (কিংবা করবে) লজিক প্রসেসিং বা যুক্তি বুঝে। সোজা বাংলায়, একদম নতুন সমস্যার বেলাতেও পরিস্থিতি বুঝে সিদ্ধান্তগ্রহণের ক্ষমতা থাকবে জেনারেল এআইয়ের। মানুষের চিন্তার ধরনের সঙ্গে যার সবচেয়ে বেশি মিল। হয়তো মানুষের মতোই বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ করতে পারবে আর্টিফিশিয়াল জেনারেল ইনটেলিজেন্স।
একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। চ্যাটজিপিটিকে আর্টিফিশিয়াল ন্যারো ইনটেলিজেন্সের শ্রেণিভুক্ত করা হয় কারণ সেটির কাজ একটি। মানুষের প্রশ্নের উত্তর কথোপকথনের মাধ্যমে দেয় চ্যাটবটটি। সেলফ-ড্রাইভিং গাড়ি চালাতে পারবে না চ্যাটজিপিটি। তবে আর্টিফিশিয়াল জেনারেল ইনটেলিজেন্স একদিকে যেমন পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে চ্যাটজিপিটির কাজ করতে পারবে, আবার নতুন প্রশিক্ষণ নিয়ে সেলফ-ড্রাইভিং গাড়িও চালাতে পারবে। এর জন্য নতুন অ্যালগরিদমের প্রয়োজন হবে না। জ্ঞান বণ্টন কিংবা অভিজ্ঞতা বিনিময়ের এই দক্ষতা জেনারেল এআইয়ের কেবল একটি দিক।
জেনারেল এআইয়ের কাজের ধরন
আর্টিফিশিয়াল জেনারেল ইনটেলিজেন্সের কাজের মূলে আছে ‘মাইন্ড এআই ফ্রেমওয়ার্ক’। ফ্রেমওয়ার্কটির মূল কাজ হলো, যন্ত্রকে মানুষের আচরণ শেখানো এবং চেতনার মৌলিক দিকগুলো সম্পর্কে জানানো।
এতে জেনারেল এআই পরিকল্পনা করা, বোধশক্তি অর্জন, অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে কাজ করা, সিদ্ধান্তগ্রহণ এবং সিদ্ধান্তগ্রহণে অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারবে। ফলে উদ্ভাবনী এবং সৃজনশীল কাজ করতে পারবে জেনারেল এআই।
এমন আরও এক্সপ্লেইনার পড়ুন এখানে
মানুষের সমকক্ষ হয়ে উঠতে হলে আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্সের চেতনার তিনটি মৌলিক উপাদান দরকার। প্রথমত, ব্যক্তিসত্তাকে কেন্দ্রে রেখে চারপাশের দুনিয়ার সঙ্গে তার সম্পর্ক বুঝতে পারার ক্ষমতা থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত, সময়ের ধারণা দরকার। বর্তমান কাজের ফল ভবিষ্যতে পাওয়ার উপলব্ধি থাকতে হবে। সঙ্গে দরকার কল্পনাশক্তি। এতে সম্ভাব্য করণীয় কাজগুলোর সম্ভাব্য ফলাফল মূল্যায়ন করে সেরা কাজটি নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হবে।
সংক্ষেপে বললে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে চারপাশ থেকে তথ্য সংগ্রহ, মূল্যায়ন, তা থেকে শেখা এবং সে অনুযায়ী কাজ করতে পারতে হবে। আবার মানুষের মতো নতুন জ্ঞানের সঙ্গে আগের অভিজ্ঞতা মিলিয়ে দেখতে পারতে হবে। বর্তমানের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মূল সীমাবদ্ধতা এখানেই।
আরও পড়ুন: কমলা ফল আগে না রং আগে?
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এখনও) যা পারে না
আর্টিফিশিয়াল ন্যারো ইনটেলিজেন্সের সীমাবদ্ধতা হলো, তথ্য প্রক্রিয়াজাত করার পর তা পরবর্তীতে অন্য অ্যাপ্লিকেশনে ব্যবহারের জন্য সংরক্ষণ করে রাখা যায় না। মানুষ যেমন একাধিক ইন্দ্রিয় থেকে পাওয়া তথ্য এককাট্টা করে কাজে লাগাতে পারে, ন্যারো এআই তেমন পারে না।
অগ্রগতি যে একদম হয়নি, তা না। চ্যাটজিপিটিতে আগে কেবল লেখা নিয়ে কাজ করা যেত, এখন সঙ্গে অডিও ও ভিডিও যুক্ত হয়েছে। তবে কোনো শিশু যেমন চোখের দেখার সঙ্গে কানের শোনা মিলিয়ে কল্পনায় নতুন কিছু অনায়াসে ভাবতে পারে, যন্ত্রকে সে ক্ষমতা দেওয়ার পথ এখনও উদ্ভাবিত হয়নি।
আবার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির অগ্রগতিকে ছোট করে দেখার সুযোগও নেই। চ্যাটজিপিটির কথাই যদি বলি, মানুষের সঙ্গে দিব্যি আলাপ চালিয়ে যেতে পারছে। গ্রাহক সেবাকর্মীর অনুপস্থিতিতে গ্রাহককে প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করতে পারে। আবার সাইবার নিরাপত্তা সিস্টেমগুলো মানুষের প্রত্যক্ষ তদারকি ছাড়াই দিনরাত সাইবার হামলার ঝুঁকি শনাক্তে কাজ করে যাচ্ছে। এ-ই বা কম কীসে?
মানুষের পক্ষে ২৪ ঘণ্টা কাজ করা সম্ভব না। এআই তা পারে। আবার তথ্য প্রক্রিয়া ও বিশ্লেষণে মানুষের চেয়ে এআই বেশি দক্ষ। তবু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কৃত্রিমই থেকে যাচ্ছে। এটাকে কম্পিউটার বিপ্লবের পরবর্তী ধাপ বলা যায়, মানুষের বুদ্ধিমত্তার সমকক্ষ না।
তা ছাড়া, ন্যারো এআই তথ্যনির্ভর মডেল। ভালো ফলের জন্য দরকার বিপুল তথ্যের। কিন্তু সম্ভাব্য সব পরিস্থিতির তথ্য ইনপুট দেওয়া কার্যত অসম্ভব। কাজটা কেমন, একটা উদাহরণ দিয়ে ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করা যাক।
ধরুন, আমরা সেলফ-ড্রাইভিং গাড়ির জন্য এআই সিস্টেম তৈরি করব। ট্র্যাফিক বাতি সবুজ দেখালে চলতে হবে, লাল দেখালে থামতে হবে। এই তথ্য এআইকে দেওয়া হলো। তবে এআই জানে না, হলুদ বাতি দেখালে কী করতে হবে। ধরুন সে তথ্যও ইনপুট দেওয়া হলো। কিন্তু এআই জানে না, সবুজ বাতি দেখালেও সামনে মানুষ এলে থামতে হবে। এবার সেটাও ইনপুট দেওয়া হলো। মানুষ এল না ঠিকই, তবে হঠাৎ যদি কুকুর এসে যায়? সেটাও জানানো হলো। কুকুরের বদলে সামনে যদি বাঘ পড়ে? চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলে বিপদ বরং বাড়তে পারে।
এভাবে প্রতিটা পদক্ষেপে কী করতে হবে, তা এআই সিস্টেমকে ডেটা ইনপুট দিয়ে জানাতে হয়। আমাদের উদাহরণ ছোট্ট। বাস্তবে এআই অ্যাপ্লিকেশন তৈরিতে কোটি কোটি ডেটা পয়েন্ট ইনপুট দিতে হয়। এতে ডেটাসেটের আকার বিশাল হয়ে যায়। তারপরও নিখুঁত করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। এমন অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে, যে তথ্য এআইকে দেওয়াই হয়নি।
আর্টিফিশিয়াল জেনারেল ইনটেলিজেন্স তৈরিতে সফল হতে চাইলে গবেষকদের প্রথম কাজ হলো ডেটাসেট বড় করার চিন্তা মাথা থেকে সরিয়ে ফেলা। এর বদলে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এআই যেন নিজে থেকেই করণীয় ঠিক করতে পারে, সিদ্ধান্ত নিতে পারে—সে চেষ্টা করতে হবে। যন্ত্রের মধ্যেও মানুষের মতোই কমনসেন্সের সঞ্চার ঘটাতে হবে।
আরও পড়ুন: চীনের তৈরি টিকটক চীনেই ব্যবহার করা যায় না কেন
জেনারেল এআই কি আদৌ সম্ভব?
সেটা একটা প্রশ্ন বটে। আর্টিফিশিয়াল জেনারেল ইনটেলিজেন্সের অপার সম্ভাবনার পরও সে তুলনায় বিনিয়োগ কম। এখন পর্যন্ত এর সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য কারণ মনে হয়েছে, জেনারেল এআই বিক্রয়যোগ্য হবে কি না তা নিয়ে শঙ্কা আছে। সেলফ-ড্রাইভিং গাড়ির প্রযুক্তি আসার সঙ্গে সঙ্গে সবাই যেমন হুমড়ি খেয়ে পড়েছে, অ্যালেক্সায় যেমন সবার আগ্রহ, চ্যাটজিপিটিকে প্রশ্ন করতে করতে প্রশ্নকর্তারই কাহিল হওয়ার দশা—এর সব কাজের কাজীতে মানুষ হয়তো আগ্রহী হবে না। কারণ মানুষের সমকক্ষ মানে ওই সব কাজ মানুষ আগে থেকেই করে আসছে। সেখানে চমক বলে কিছু থাকে না।
আরেকটা কারণ হলো, জেনারেল এআই আদৌ তৈরি সম্ভব কি না, তা নিয়েও হয়তো সন্দেহ আছে। এই সন্দেহের একটা কারণ, মানুষের মস্তিষ্কের কাজের ধরনের পরিপূর্ণ মডেল তৈরি করা সম্ভব হয়নি এখনও। আর মডেল না থাকলে নকল করবে কীভাবে?
এখন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এক এআই অ্যালগরিদম দিয়ে একাধিক কাজ করানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। এরপর হয়তো অ্যালগরিদমগুলোকে একীভূত করার চেষ্টা করা হবে। তখন কিছুটা হাইব্রিড মডেলের এআই পাওয়া যেতে পারে বলে মনে করা হয়। সেটা হয়তো কিছু ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে, আবার কিছু ক্ষেত্রে বর্তমান নিয়ম মেনে কাজ করবে। আবার হতে পারে, জেনারেল এআইয়ের যে ধারণা আমাদের মনে আছে, তা হয়তো পুরোপুরি ঠিক না। মানুষের মতো করে ভাবার হয়তো দরকারই নেই যন্ত্রের। হয়তো চিন্তার ভিন্ন ধারা কিংবা কে জানে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।
শেষমেশ জেনারেল এআই অর্জন সম্ভব হবে কি না, তা সময়ের হাতে ছেড়ে দেওয়া ছাড়া আপাতত কিছু করার নেই। এটুকু কেবল বলা যায়, সামনের দিনগুলোতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে আরও চমৎকার সব গবেষণা হবে, চমৎকার সব ব্যবহার আমরা দেখতে পাবো, সেটুকু অন্তত নিশ্চিত।
আরও পড়ুন: মূল্যস্ফীতি কী, কেন হয় | মূল্যস্ফীতিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি কার