চীনের তৈরি টিকটক চীনেই ব্যবহার করা যায় না কেন
টিকটক তৈরি হয়েছে চীনে। কিংবা চীনা প্রযুক্তিতে তৈরি বলা চলে। অথচ সেই চীনেই অ্যাপটি ব্যবহার করা যায় না। পরিবর্তে টিকটকের মাতৃপ্রতিষ্ঠান বাইটডান্সের ‘দৌইন’ নামের আরেকটি অ্যাপ সেখানে প্রচলিত।
টিকটকের আগেই দৌইন অ্যাপটি চীনে ছাড়া হয়। তরুণদের মধ্যে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে সেটি। দৌইনের অ্যালগরিদমের ওপর ভিত্তি করেই পরবর্তীতে তৈরি হয় টিকটক, সেটাও বিশ্বব্যাপী তরুণদের মধ্যে দ্রুতই সাড়া ফেলে।
অ্যাপদুটির মালিকানা এক, ব্যবহারের ধরন এক, তবে পরিচালন পদ্ধতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। চলুন জানার চেষ্টা করা যাক কেন সে পার্থক্য।
দৌইন তুমুল জনপ্রিয়
দৌইনের দৈনিক ব্যবহারকারী এখন প্রায় ৬০ কোটি। টিকটকের মতো সেটাতেও ছোট ভিডিও শেয়ার করা যায়। দৌইন প্রকাশ করা হয় ২০১৬ সালে। টিকটক চালুর আগেই সেটি থেকে দেদারসে আয় করতে থাকে বাইটডান্স।
বাইটডান্স প্রতিষ্ঠা করেন মাইক্রোসফটের সাবেক কর্মী জাং ইমিং। ২০১২ সালে জিনরি তৌতিয়াও (বাংলায় ‘আজকের শিরোনাম’) নামে সংবাদভিত্তিক একটি অ্যাপ তৈরি করে পরিচিত পান তিনি।
তৌতিয়াও অ্যাপে ব্যবহারকারীর পছন্দ অনুযায়ী নিউজ ফিড তৈরির সুযোগ ছিল। ব্যবহারকারীরাও তাতে আকৃষ্ট হয়, দিনে গড়ে ৭০ মিনিট করে সময় কাটাতেন। দৌইনের বেলাতেও একই ধরনের ফরমুলা প্রয়োগ করা হয়।
জাং ইমিংয়ের বাইটডান্স ২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের একটি ভিডিও স্টার্টআপ কিনে নিয়ে দৌইনের বিদেশি সংস্করণ হিসেবে টিকটক প্রকাশ করে। সে সময় মিউজিক্যালি নামে আরেকটি অ্যাপ কিনে নিয়ে ২০১৮ সালে মিউজিক্যালির ব্যবহারকারীদের টিকটকে আনা হয়।
সে থেকে অ্যাপটির জনপ্রিয়তা বাড়ছেই। ২০২১ সালে বিশ্বব্যাপী ১০০ কোটি মাসিক ব্যবহারকারীর মাইলফলক ছাড়িয়ে যায় টিকটক।
বিউটি ফিল্টারের ছড়াছড়ি
টিকটক ও দৌইনের ইউজার ইন্টারফেস দেখতে কাছাকাছি। তবে ক্যামেরা চালু করলেই পার্থক্য চোখে পড়ে। দৌইনে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিউটি ফিল্টার চালু হয়ে যায়, এতে ব্যবহারকারীর চেহারায় বেশকিছু পরিবর্তন আসে।
চীনা নারীরা সৌন্দর্যের তথাকথিত মাপকাঠির চাপে ভোগেন। স্লিম ফিগার থাকতে হবে, চোখ বড় বড় লাগবে, কোমল ত্বক আর উঁচু চিকবোন না হলে চলবে না। সে কারণে দেশটিতে প্লাস্টিক সার্জারির চাহিদা ব্যাপক। ২০১৪ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে চীনে প্লাস্টিক সার্জারির হার দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে।
এদিকে বিউটি অ্যাপগুলোর মধ্যে শুরু হয় ফিল্টার তৈরির প্রতিযোগিতা। এতে ব্যবহারকারীর চেহারা ক্যামেরায় আরও সুন্দর দেখায়। টিকটকেও বিউটি ফিল্টার আছে, তবে তা নিজে নিজেই চালু হয়ে যায় না। ব্যবহারকারী চাইলে ঠিক করে দিতে পারেন।
দৌইনে কেনাকাটার সুবিধা বেশি
টিকটক ও দৌইনের মধ্যে আরেকটা বড় পার্থক্য আছে। চীনের বিশাল অনলাইন বাজার ধরার চেষ্টায় আছে দৌইন।
চীনের মূল ভূখণ্ডে লাইভস্ট্রিমিংয়ে পণ্য বিক্রি তুমুল জনপ্রিয়। একে ঘিরে মাল্টি-বিলিয়ন ডলারের ইন্ডাস্ট্রি। করোনাকালে তা আরও বেড়েছে।
বেইজিংয়ের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অ্যাকাডেমি অব চায়না কাউন্সিল ফর দ্য প্রমোশন অব ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডের হিসাব অনুযায়ী, ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত চীনের মূল ভূখণ্ডে লাইভস্ট্রিমিং ই-কমার্স ব্যবহারকারী ছিল ৪৬ কোটির বেশি।
লাইভস্ট্রিমারদের কাছে দৌইন গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্মগুলোর একটি। অ্যাপেই কেনাকাটার বেশকিছু অপশন আছে। লাইভস্ট্রিম ভিডিওতেই পর্দায় ছাড়ের পরিমাণ দেখায়, সোয়াইপ কিংবা এক ক্লিকেই কেনাকাটার সব আয়োজন সম্পন্ন করা যায়।
সেন্সরশিপের কড়াকড়ি
সেন্সরশিপ আরেকটি বড় ইস্যু। চীন এ বিষয়ে বরাবরই কঠোর। দৌইনেরও তা না মেনে উপায় নেই।
অনলাইনে ভিন্নমত কিংবা রাজনৈতিক সংবেদনশীল তথ্য পেলে ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো সেটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে থাকে।
দৌইনে তিয়ানআনমেন হত্যাকাণ্ড লিখে খুঁজলে কোনো কিছু দেখায় না। তবে টিকটকে অনেক কিছু আসে। বেইজিংয়ে স্বাধীনতাকামী আন্দোলনকারীদের ওপর চীনা সামরিক বাহিনীর নিষ্ঠুর সে হামলা চীনের ইতিহাসের বই থেকে এরই মধ্যে মুছে ফেলা হয়েছে। সে ঘটনা নিয়ে অনলাইনে উন্মুক্ত আলোচনার সুযোগও নেই চীনে।
কমবয়সীদের ওপর বিধিনিষেধ
১৪ বছরের কমবয়সী ব্যবহারকারীরা দিনে ৪০ মিনিটের বেশি দৌইন ব্যবহার করতে পারে না। আবার রাত ১০টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত অ্যাপটি ব্যবহারের সুযোগও নেই তাদের। তা ছাড়া শিশুদের জন্য নিরাপদ হিসেবে চিহ্নিত কনটেন্টগুলোই কেবল তাদের সামনে আসে।
দীর্ঘদিন ধরেই শিশুদের ভিডিও গেম আসক্তি এবং অনলাইনে অস্বাস্থ্যকর অভ্যাস কমিয়ে আনার চেষ্টায় আছে চীন। ২০১৯ সালে অপ্রাপ্তবয়স্কদের জন্য অনলাইনে গেমিংয়ে কারফিউ ঘোষণা করে দেশটির সরকার। সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতেও ১৮ বছরের কমবয়সীরা তিন ঘণ্টার বেশি ভিডিও গেম খেলতে পারে না।
কাছাকাছি পদক্ষেপ নিয়েছে টিকটকও। ১৮ বছরের কমবয়সীদের অ্যাকাউন্টগুলোর স্ক্রিনটাইম এক ঘণ্টায় সীমিত করে দেওয়া হবে। অবশ্য ব্যবহারকারীরা চাইলে সেটিংস থেকে সে সময় বাড়িয়ে নিতে পারে।
কেবল টিকটক না
চীনে শুরু হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে জনপ্রিয়তা পাওয়া টিকটক একমাত্র প্ল্যাটফর্ম না। অ্যাপলের অ্যাপ স্টোরের মার্কিন সংস্করণের জনপ্রিয় ফ্রি ১০ অ্যাপের চারটিই চীনা প্রযুক্তিতে তৈরি। টিকটকের পাশাপাশি শপিং অ্যাপ টেমু, পোশাক বিক্রেতা শেইন এবং ভিডিও সম্পাদনার অ্যাপ ক্যাপকাট এই তালিকায় আছে।
যুক্তরাষ্ট্রে টিকটক তুমুল জনপ্রিয়। মাসে ১৫ কোটি ব্যবহারকারী আছে দেশটিতে, যুক্তরাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের কাছাকাছি। তবে টিকটক মার্কিন নীতিনির্ধারকদের সন্তুষ্ট করতে পারে কি না, এখন সেটাই দেখার বিষয়।
যুক্তরাষ্ট্রে টিকে থাকার লড়াই চালাচ্ছে চীনা মালিকানাধীন টিকটক। ভিডিও শেয়ারের অ্যাপটির মার্কিন অংশ কোনো মার্কিন প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রির প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। সেটা না মানলে যুক্তরাষ্ট্রে টিকটক নিষিদ্ধের জন্য ওয়াশিংটনের প্রতিনিয়ত বাড়ছে চাপ।
এদিকে ডেটা প্রাইভেসি এবং নিরাপত্তা নিয়ে ওয়াশিংটনের আলাপআলোচনা থেকে আঁচ করা যাচ্ছে, অন্যান্য অ্যাপগুলোও নজরদারির আওতায় আসতে পারে।
সূত্র: সিএনএন