এক কাজ করেও মার্কিন ও রুশ নভোচারীরা আলাদা কেন
আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে এখন কাজ করছেন মোট সাত নভোচারী। তাঁদের চারজন মার্কিন, দুজন রুশ ও একজন জার্মান। তাঁদের মূল কাজ গবেষণা। স্টেশনের রক্ষণাবেক্ষণও তাঁরাই করেন।
মজার ব্যাপার হলো বাংলায় আমরা তাঁদের সবাইকে নভোচারী বললেও রুশ দুজন কিন্তু ‘কসমোনট’, বাকি পাঁচজনকে ‘অ্যাস্ট্রোনট’ বলা হয়। বলুন তো, একই ধরনের কাজ করেও তাঁদের নামের এই তফাত কেন? সে আলোচনায় যাব, তবে এর আগে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন বা আইএসএস নিয়ে দুটো কথা বলে রাখি।
আইএসএস আকারে ছয় শয়নকক্ষের বাড়ির সমান
ভূমি থেকে প্রায় ২৫০ মাইল উঁচুতে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করা আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন আদতে বড়সড় এক কৃত্রিম উপগ্রহ। যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে সহযোগিতা ও সমন্বয়ের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ সেটি।
১৯৯৮ সালে আইএসএসের প্রথম অংশ মহাকাশে পাঠানো হয়েছিল রুশ রকেটে। এরপর ক্রমে তাতে অন্যান্য অংশ যুক্ত করা হয়। আর প্রথম মানুষ পাঠানো হয় ২০০০ সালের নভেম্বরে, সে থেকে কখনো ফাঁকা থাকেনি কৃত্রিম উপগ্রহটি।
মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার তথ্য বলছে, আইএসএস আকারে ছয় শয়নকক্ষের এক বাড়ির সমান। ছয়টি অংশে নভোচারীদের ঘুমানোর ব্যবস্থা আছে। সঙ্গে আছে দুটি বাথরুম, একটি ব্যায়ামাগার এবং চারদিক দেখার মতো বিশাল একটি জানালা। যেকোনো সময় একসঙ্গে আটটি নভোযান আইএসএসে যুক্ত হতে পারে।
একই কাজ করেও নভোচারীরা কেন আলাদা
এবার আসা যাক শিরোনামের প্রশ্নে। অ্যাস্ট্রোনট ও কসমোনটের কাজে তেমন কোনো তফাত নেই। যে সংস্থার হয়ে তাঁরা কাজ করেন, যাদের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ পান, পার্থক্যটা সেখানে।
মহাকাশে পেশাদার কাজের জন্য যদি কেউ যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা, ইউরোপের ইএসএ, কানাডার সিএসএ কিংবা জাপানের জাক্সা থেকে সনদসহ প্রশিক্ষণ নেন, তবে তাঁদের ‘অ্যাস্ট্রোনট’ বলা হয়।
অন্যদিকে, একই কাজের জন্য রাশিয়ার মহাকাশ এজেন্সি রসকসমস থেকে যাঁরা সনদ পান, তাঁদের বলা হয় ‘কসমোনট’। আর চীনের বেলায় শব্দটি ‘তাইকোনট’।
কালো আর ধলো বাইরে কেবল…
অ্যাস্ট্রোনট শব্দটি গ্রিক ‘অ্যাস্ট্রোন’ (নক্ষত্র) এবং ‘নটিস’ (নাবিক) থেকে নেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ যিনি নক্ষত্রের মধ্যে দিয়ে চলেন, তিনিই অ্যাস্ট্রোনট। কসমোনট শব্দটির উৎপত্তিও গ্রিক শব্দ ‘কসমস’ ও ‘নটিস’ থেকে। কসমসের অর্থ মহাবিশ্ব। সেদিকে থেকে অ্যাস্ট্রোনট এবং কসমোনটের অর্থ একই।
অর্থ এক, কাজ এক, তবু এই তফাত কেন? উত্তর হলো, ‘স্পেস রেস’।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে পশ্চিমা দেশগুলো শীতল যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। সে আলোচনা অবশ্য বহুল চর্চিত। তবু দুটো লাইন এখানে রাখা যেতে পারে।
সোভিয়েত কমিউনিস্ট রাষ্ট্র। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মতো রাষ্ট্রগুলো পুঁজিবাদী। এই দুই ঘরানা সে সময় প্রতিযোগিতায় জড়িয়ে পড়ে। সেরা প্রযুক্তি, সেরা অস্ত্র তৈরি করে একে অপরের চেয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে।
তবে শুধু এগিয়ে গেলেই তো আর হলো না, সেটা দেখানোও চাই। দুপক্ষই বুঝল, মহাকাশে আধিপত্য বিস্তার করতে পারলে সেটা হবে দেখার (মতান্তরে দেখানোর) মতো ব্যাপার। স্পেস রেসে শুরুতে অবশ্য রুশরাই এগিয়ে ছিল।
১৯৫৭ সালে মহাকাশে প্রথম প্রাণশূন্য নভোযান পাঠায় সোভিয়েত ইউনিয়ন। ১৯৬১ সালে পাঠায় কুকুর। মহাকাশে প্রথম মানুষ ইউরি গ্যাগারিনও সোভিয়েত ইউনিয়নের। মার্কিনদের সবচেয়ে বড় চমক ছিল সম্ভবত চাঁদে প্রথম মানুষের পদার্পণ।
যাহোক, ওই সময়ে দুই দেশই নিজেদের নভোচারীদের আলাদা করে চেনাতে চেয়েছিল। সে চেষ্টা থেকে যুক্তরাষ্ট্র ঠিক করে ‘অ্যাস্ট্রোনট’, সোভিয়েত ইউনিয়ন নেয় ‘কসমোনট’। দুই দেশের মহাকাশ সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী ‘অ্যাস্ট্রোনট’ কিংবা ‘কসমোনট’ হওয়ার মধ্যে যৎসামান্য তফাত আছে বটে। তবে কাজ কিন্তু তাঁরা একই করেন।
সূত্র: বিবিসি, স্পেস ডটকম