মানুষের জীবন বদলে দেওয়া ১০ প্রযুক্তি
ধরে নিচ্ছি এই নিবন্ধ যিনি পড়ছেন, মাইক্রোসফট এবং অ্যাপলের দ্বৈরথ সম্পর্কে তিনি জানেন। পিঠোপিঠি জন্ম নেওয়া প্রতিষ্ঠান দুটি চার দশকের বেশি সময় ধরে পাশাপাশি চলছে। প্রতিদ্বন্দ্বী। কখনো কখনো হাতও মিলিয়েছে।
প্রতিষ্ঠার পরপর স্টিভ জবসের কারিশমায় মাইক্রোসফটের চেয়ে কয়েক কদম এগিয়েই ছিল অ্যাপল। তবে নিজের প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান থেকেই সরিয়ে দেওয়া হয় তাঁকে। ফলাফল? পিছিয়ে পড়তে পড়তে এক সময় দেউলিয়া হতে বসে।
ঠিক এমন সময় অ্যাপলে পুনরায় ফেরেন স্টিভ। ১৯৯৭ সালের ঘটনা। উপায়ন্তর না দেখে যোগাযোগ করেন মাইক্রোসফটের কর্ণধার বিল গেটসের সঙ্গে। এগিয়ে আসেন বিল। ১৫ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেন অ্যাপলে। বলা বাহুল্য, সে টাকা না পেলে আজ অ্যাপল শুধু গাছ থেকেই পেড়ে খেতে হতো।
আরও এক যুগ পর সেই ত্রাতা মাইক্রোসফটকে পেছনে ফেলে অ্যাপল। বাজারমূল্যের বিচারে সফলতম প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের খেতাব পায় ২০১০ সালের ২৬ মে। মাইক্রোসফট কিন্তু থেমে ছিল না। সে-ও এগোচ্ছিল। কিন্তু অ্যাপলের গতির সঙ্গে পেরে ওঠেনি। প্রশ্ন হলো, কীভাবে?
আগের অ্যাপল আর পরের অ্যাপলের মধ্যে পার্থক্য এক আইফোন। স্টিভ জবসের হাত ধরে ২০০৭ সালে বাজারে আসে নতুন ঘরানার এই স্মার্টফোন। এসেই বাজিমাত। এরপর অ্যাপলের আরও বাজার সফল পণ্যের দেখা মিলেছে তবে আইফোনের ধারেকাছে নয়। এর পরপর শুরু হলো অ্যান্ড্রয়েড বিপ্লব। লোকে বলতে শুরু করল, ঘরে ঘরে টিভির পর এবার হাতে হাতে স্মার্টফোন। মানুষের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে মিশে গেল।
আর তাই আমরা গত দশকের তথ্যপ্রযুক্তির গুরুত্বপূর্ণ ধারার তালিকা করতে বসলে, ঘুরেফিরে স্মার্টফোনের অভ্যুত্থানের কথাই লিখতে হয় বারবার। এই তালিকা তৈরি করেছে মার্কিন সাময়িকী সিনেট। আমার মনে হয় না, দ্বিমত করার সুযোগ আছে।
১০. অ্যাপে ভাগাভাগি গাড়ি-বাড়ি
ইদানীং একটা কথা প্রায়ই শোনা যাচ্ছে—‘উবার এসে সিএনজির ভাত মেরে দিয়েছে’। কথায় কিছুটা সত্যতা আছে। সিএনজি অটোরিকশা চালকেরা নিশ্চয় বেঁচেবর্তে আছেন। তবে রাজধানীসহ যেখানে উবার, পাঠাও বা এ ধরনের রাইড ভাগাভাগির সেবা আছে, সেখানে তাঁদের চাহিদা কমেছে। অ্যাপে ডাকলেই মিলছে গাড়ি কিংবা মোটরসাইকেল। ভাড়াও হাতের নাগালে। দর-কষাকষির ঝামেলা নেই। কিংবা ধরুন, কোথাও গিয়ে থাকার জায়গা দরকার। অ্যাপে এয়ারবিএনবিতে ফরমাশ জানালেই বাজেটের মধ্যে মিলবে কক্ষ।
সামগ্রিক বিচার করলে দেখবেন, নতুন একটা ধারা শুরু হয়েছে। অনেকে বলেন, শেয়ারিং ইকোনমি। যেমন আমার গাড়ি বা বাড়ি আছে। এই মুহূর্তে পুরোটা লাগছে না। আমি চাইলে ভাগাভাগি করতে পারি। সেটা গাড়ির আসন হতে পারে, বাড়ির কক্ষও হতে পারে। বিনিময়ে আমি কিছু টাকা পেলাম। অপরপক্ষের মিটল প্রয়োজন। এই নতুন ধারার শুরু এই দশকেই। সুযোগ করে দিয়েছে স্মার্টফোন। কিছু বিতর্ক আছে। মুদ্রারও তো দুই পিঠ থাকে।
৯. হারিয়ে গেল হেডফোন জ্যাক
২০১৬ সালে আইফোন ৭ বাজারে এলে মোটামুটি সবার একই প্রশ্ন—হেডফোন জ্যাক কই? অ্যাপলের উদ্দেশ্য ছিল, তারহীন বিশ্বের পথে আরেক কদম এগিয়ে যাওয়া। বাজারে আনল তারহীন ইয়ারবাডস। নাম দিল এয়ারবাডস। সঙ্গে সঙ্গে লোকে অপছন্দ করল। কেউ কেউ তার যুক্ত হেডফোনের সঙ্গে নিজের এত দিনের আবেগঘন সম্পর্কের বর্ণনা দেওয়া শুরু করল। কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সবাই সাদরে গ্রহণ করল নতুন এই ধারা। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানও ইয়ারবাডস ছাড়তে শুরু করল। স্যামসাং, গুগল, শাওমি—সবাই। মাঝখান থেকে শীর্ষস্থান পেয়ে গেল অ্যাপল।
আরও পড়ুন: উড়োজাহাজের সবচেয়ে নিরাপদ আসন যেখানে
৮. অ্যালেক্সা আন্দোলন
২০১৪ সালে আমাজনের ইকো সিরিজের স্মার্ট স্পিকার বাজারে এলে সবাই মাথা চুলকে বলেছিল, এতে নতুন কী? গড়পড়তা ব্লুটুথ স্পিকার, দেখতে আবার প্রিঙ্গেলস চিপসের মোড়কের মতো, বড়জোর দু-চারটে মুখস্থ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে। বলা বাহুল্য, মানুষ সেদিন অ্যালেক্সা তথা ভার্চ্যুয়াল সহকারীর ক্ষমতা ছোট করে দেখেছিল। এরপরের বছরগুলোতে সে স্পিকারের দাম কমতে থাকল, আকার ছোট হতে শুরু করল, সবচেয়ে বড় কথা মানুষের রান্নাঘর থেকে শোয়ার ঘরে পর্যন্ত জায়গা করে নিল। ভাবখানা এমন—এই দুনিয়াতে অন্তত একটা জিনিস মিলল যা প্রশ্ন না করেই আমার হুকুম তামিল করে। এরপর প্রতিযোগিতায় অংশ নিল গুগল, তার পিছু পিছু অ্যাপল। তত দিনে নাগালের বাইরে চলে গেছে আমাজন।
৭. শরীরে কম্পিউটার
অ্যাপল ওয়াচ আমাদের কবজিতে শুধু ঘড়ি না, পুরো এক কম্পিউটার জুড়ে দিয়েছে। ২০১৫ সালে জনসাধারণ কিন্তু তা অনুমান করতে পারেনি। সবাই ভেবেছিল, ফিটবিটের বড় সংস্করণ। বড়জোর একটু বেশি স্মার্ট। বছর কয়েক পরেই অ্যাপলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা টিম কুক মঞ্চে ঘোষণা করলেন, অ্যাপল ওয়াচ শুধু সেরা স্মার্টঘড়িই না, সেরা ঘড়ির ব্র্যান্ডও। পাশাপাশি অন্যান্য স্মার্টঘড়ি এবং ফিটনেস ট্র্যাকারের উৎপাদন চলেছে দেদারসে। রীতিমতো পরিধেয় প্রযুক্তির বিপ্লব। এদিকে গুগল গ্লাস নামে স্মার্ট চশমা বানিয়েছিল গুগল। সময়ের চেয়ে সে প্রকল্প বেশ এগিয়ে ছিল বলে সে সময় বাজার পায়নি। অপেক্ষা করুন, আগামী দু-এক বছরের মধ্যে সব কোম্পানিগুলো স্মার্ট চশমা তৈরির পেছনে ছুটবে।
৬. বৈদ্যুতিক গাড়ি এল, বাদ পড়ল চালক
এই তালিকায় টেসলার নাম রাখা প্রয়োজন। যদিও তাদের উৎপাদন খুব সীমিত, অন্তত তালিকার অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোর তুলনায় তো বটেই। তবু বিশ্বের বাঘা বাঘা গাড়ি উৎপাদনকারীরা নয়, বিশ্বকে বৈদ্যুতিক এবং চালকবিহীন গাড়ির পথে এগিয়ে নিয়েছে টেসলা। দেখানো সে পথেই হেঁটেছে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলো। সবচেয়ে বড় কথা, শুধু সফটওয়্যার হালনাগাদের মাধ্যমে সাধারণ গাড়িকে চালকবিহীন গাড়িতে রূপান্তরের পথ দেখিয়েছে টেসলা। আরেকটি বিষয় হলো, গাড়ি উৎপাদনকারী নয় বরং প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি ধরে রেখেছে টেসলা।
আরও পড়ুন: বারবার চার্জে কি স্মার্টফোনের ক্ষতি হয়?
৫. প্রযুক্তি সমস্যা, প্রযুক্তিই সমাধান
ডিজিটাল যুগের সবচেয়ে বড় ক্ষতিকর দিক হলো, মানুষ বসে বসে পর্দার দিকে তাকিয়ে থাকা শুরু করল। মানসিক ও শারীরিক, দুভাবেই ক্ষতি করে গেল। স্বাভাবিকভাবেই মানুষ একসময় সচেতন হতে শুরু করল। তবে সমাধান দিল ওই প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো। শারীরিক ব্যায়াম, খাদ্যাভ্যাস আর ঘুমের পথ বাতলে দেওয়া শুরু করল। ব্যায়ামের দায়িত্ব নিল অ্যাপল ওয়াচ বা ফিটবিটের মতো ফিটনেস ট্র্যাকার। মাই ফিটনেস প্যাল বা লুজ ইটের মতো সেবাগুলো খাদ্যাভ্যাসে নজর দিল। স্লিপওয়াচ অ্যাপ বা স্লিপ নাম্বারের মতো বিছানা তৈরি হলো ভালো ঘুমের জন্য। মানে প্রযুক্তি আসক্তির ক্ষতিকর দিক কাটাতে মানুষ সেই প্রযুক্তিকেই আশ্রয় করে নিল।
৪. বদলে গেল টিভি
ডিশের লাইন বলতে আমরা মূলত স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল দেখার সংযোগ বুঝি। প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো এসে বলল, আমরা তোমাদের টিভি দেখাব ডিজিটাল পদ্ধতিতে, তোমার বিদ্যমান ইন্টারনেট সংযোগের সাহায্যে। আর সুবিধার মধ্যে, যে কয়টা চ্যানেল তুমি নিয়মিত দেখ, শুধু সে কয়টার টাকা দিতে হবে। রাজ্যের চ্যানেলের তোমার দরকার কী? মানুষ গ্রহণ করল। কিছুটা অর্থ বাঁচানোর তাগিদে, কিছুটা নতুন মাধ্যমে টিভি দেখার বাসনায়। টিভি তো স্মার্ট হলো। স্মার্টফোন, ট্যাব, কম্পিউটারের পর্দাতেও টিভি দেখার সুযোগ তৈরি হলো। যেখানে ইচ্ছা যখন ইচ্ছা। রোকু, ফায়ার টিভি, অ্যাপল টিভির মতো স্ট্রিমিং বক্স এল বাজারে। আর টিভি শো দেখার জন্য এল নেটফ্লিক্স, হুলু, ইউটিউব, এইচবিও। মোটকথা বদলে গেল টিভি, কিংবা টিভি দেখার ধরন।
৩. পর্দার পেছনে ক্লাউড, বিগ ডেটা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা
এতক্ষণ চলচ্চিত্র দেখলাম। এবার দেখব পর্দার পেছনের দৃশ্য। ক্লাউড কম্পিউটিং, বিগ ডেটা আর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মিলিয়ে নতুন নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিল আমাদের বিদ্যমান যন্ত্রগুলোর মাধ্যমে। এই প্রযুক্তিগুলোর উন্নয়ন না হলে, আমাদের স্মার্টফোন স্মার্ট হয়ে উঠত না। আমাজন অ্যালেক্সা, গুগল অ্যাসিস্ট্যান্ট, ড্রপবক্স, অ্যাপল আইক্লাউড, মাইক্রোসফট ওয়ানড্রাইভ—ব্যবহারকারীর হাতের নাগালে আছে এমন কয়েকটি সেবার উদাহরণ। আরও বহু প্রযুক্তি আছে যা আমাদের মতো ব্যবহারকারীর চোখের আড়ালেই কাজ করে যাচ্ছে। মাইক্রোসফট কিন্তু নিজেদের বদলে ক্লাউড কোম্পানি হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে।
২. ব্যবহারকারীর হাতে নতুন ধারার কম্পিউটার
২০১০ সালের জানুয়ারিতে দেখা দিল আইপ্যাড। সে সময় লোকে প্রশ্ন করল, আইপ্যাডকে কি কম্পিউটার বলা হবে কি না? উত্তর ওই ব্যবহারকারীরাই দিয়েছে। যেখানে শক্তিশালী কম্পিউটারের প্রয়োজন নেই, সেখানে আইপ্যাড বা ট্যাবলেটই কম্পিউটারের সব কাজ করে দিতে পারে। এরপর ল্যাপটপ আর ট্যাবলেটের মধ্যে সূক্ষ্ম সীমা টেনে যুক্ত হলো গুগলের ক্রোমবুক। বদলে গেল কাজের ধরন। মানে পেশাদার ব্যবহারকারীদের জন্য বড় কম্পিউটার আরও বড় হোক, তবে সাধারণ ব্যবহারকারীদের বেলায় ট্যাবই যথেষ্ট। চাইলে একটা কি-বোর্ড জুড়ে নাও।
আরও পড়ুন: স্মার্টফোন একবার চার্জ করলে কত টাকার বিদ্যুৎ খরচ হয়
১. ফোরজির কল্যাণে পকেটে ঠাঁই নিল বিশ্ব
আমরা এই তালিকায় ফাইভজি রাখতে পারছি না। গুটিকয়েক ব্যবহারকারী দিয়ে তো আর ধারা ঠিক করা যায় না। বাংলাদেশি ব্যবহারকারীরা হয়তো অস্বীকার করবেন, তবে এই দশকে মানুষের জীবন বদলে দিয়েছে ফোরজি নেটওয়ার্ক। ইন্টারনেট ব্যবহারে ‘গতি’ এল মানুষের জীবনে। উবার, নেটফ্লিক্সের মতো সেবাগুলোর জনপ্রিয়তার পেছনে ফোরজির গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। আর সে কারণেই হয়তো মানুষ ফাইভজির জন্য অধীর হয়ে অপেক্ষা করছে। থ্রিজির তুলনায় ফোরজি দিল পাঁচ গুণ বেশি গতি। আর ফোরজির তুলনায় ফাইভজি দেবে ১০ থেকে ১০০ গুণ বেশি গতি। এই দশকের ওপরের ভিত্তি করে পরবর্তী দশক, অন্তত প্রযুক্তির দিক থেকে হয়তো চমৎকার হবে। পাশাপাশি চলবে বিতর্ক।