ফেসবুকে দুই মিনিটের জন্য ঢুকলে ঘণ্টা পেরিয়ে যায় কেন
টিম কেন্ডাল ছিলেন ফেসবুকের ‘ডিরেক্টর অব মানিটাইজেশন’। যে বিজ্ঞাপননির্ভর ব্যবসায়িক মডেলে সামাজিকমাধ্যমটি বিলিয়ন ডলার আয় করে, সেটি তার হাতেই গড়া। অথচ ২০২০ সালে মার্কিন কংগ্রেসের এক শুনানিতে জোর গলায় তিনি বলেছিলেন, ফেসবুক ধূমপানের মতো আসক্তিকর। আর প্রতিষ্ঠানটি তা জেনেবুঝেই করেছে।
টিম কেন্ডাল না বললে আমরা জানতাম না, ব্যাপারটা তা না। তবে ফেসবুক কীভাবে বছরের পর বছর ব্যবহারকারীদের মধ্যে এই আসক্তি ধরে রেখেছে, তার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন টিম। বলেছিলেন, ‘তামাকজাত পণ্য প্রস্তুতকারীরা শুরুতে কেবল নিকোটিনের ওপর জোর দিতে চেয়েছিল। তবে তাতে ব্যবসার পরিসর তাদের চাওয়া অনুযায়ী যথেষ্ট দ্রুত বাড়ছিল না। পরে সিগারেটে তারা চিনি এবং মেন্থল যোগ করল যেন ধূমপায়ীরা ফুসফুসে দীর্ঘক্ষণ ধোঁয়া ধরে রাখতে পারেন। আর ফেসবুকে আমরা স্ট্যাটাস আপডেট যোগ করলাম, লাইক যোগ করলাম, ছবিতে ট্যাগ করার সুবিধা দিলাম।’
কেন সে সুবিধা দিলেন? কারণ নিত্যনতুন সুবিধা দেয়ার মাধ্যমে ফেসবুক মানুষের মনোযোগ চায়। এবং প্রতিদিন যেন সেই মনোযোগ বাড়তে থাকে, তা-ও চায়। ব্যবহারকারীর এই মনোসংযোগকে পুঁজি করেই ফেসবুকের ব্যবসায়িক পরিসর।
ব্যবহারকারীর মনোযোগ ধরে রাখতে ফেসবুকের অ্যালগরিদম এমনভাবে সাজানো হয়েছে যেন নিউজফিডে অদ্ভুত-ঘৃণামূলক-বিদ্বেষাত্মক কনটেন্ট বেশি দেখানো হয়। কারণ, এতে ব্যবহারকারীর মধ্যে তীব্র আবেগ তৈরি করে এবং ব্যবহারকারীরা ফেসবুক ব্যবহারে আরও বেশি মনোযোগী হয়ে ওঠে।
টিম কেন্ডালকে হয়তো অনেকেই দেখেছেন। নেটফ্লিক্সের ডকুড্রামা ‘দ্য সোশ্যাল ডিলেমা’য় ছিলেন তিনি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ক্ষতিকর দিক নিয়ে কথা বলেছেন সেখানে। টিম কেন্ডালের কথা আপাতত থাকুক। তার আগে চলুন দেখা যাক, নিত্যনতুন সুবিধা দিয়ে ফেসবুক কীভাবে ব্যবহারকারীদের মনোযোগ ধরে রাখার চেষ্টা করে।
মনোযোগের অর্থনীতি
তাত্ত্বিক পদার্থবিদ মাইকেল গোল্ডহ্যাবার ১৯৯৭ সালে ‘ওয়্যার্ড’ সাময়িকীতে ‘অ্যাটেনশন শপার্স’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লেখেন। তিনি দেখালেন, শিল্পনির্ভর দেশগুলোর অর্থনীতিতে দ্রুত পরিবর্তন আসছে। উৎপাদন, পরিবহন বা বিতরণের মতো কাজগুলো থেকে সরে এসে কর্মীরা এখন তথ্য ব্যবস্থাপনায় বেশি সময় ব্যয় করছেন। অনেকে এটাকে ‘ইনফরমেশন ইকোনমি’ বললেও দ্বিমত করেন গোল্ডহ্যাবার।
গোল্ডহ্যাবারের যুক্তি হলো, দুষ্প্রাপ্য সম্পদের বণ্টন কীভাবে হবে, তা ঠিক করা অর্থনীতির কাজ। আর ইন্টারনেটের এই যুগে তথ্য কোনোভাবেই দুষ্প্রাপ্য নয়। টুভালুর রাজধানীর নাম এক ক্লিকেই মেলে। রাস্তার ওপারের রেস্তোরাঁর খাবার কেমন তা জানতে রাস্তা পেরোনোর দরকারও নেই, গুগলে রিভিউ খুঁজলেই হলো।
তথ্যের এই যুগে দুষ্প্রাপ্য যদি কিছু হয়, তবে তা ব্যবহারকারী অর্থাৎ আমাদের মনোযোগ। কারণ তথ্যের প্রবাহ বাড়লেও সেই তথ্য প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য মানসিক ক্ষমতা তো আগের মতোই আছে। তা ছাড়া এখনো ২৪ ঘণ্টাতেই দিন, বাড়েনি সময়ও। সে কারণেই গোল্ডহ্যাবার বললেন, তথ্য নয়, বরং ডিজিটাল জগতের অর্থনীতি হলো মনোযোগের অর্থনীতি।
তবে ‘অ্যাটেনশন ইকোনমি’ শব্দদ্বয়ের প্রচলন করেন অর্থনীতিতে নোবেলজয়ী রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হার্বার্ট এ সাইমন। তিনি বলেন, ‘তথ্যের প্রাচুর্যে মনোযোগ দুষ্প্রাপ্য হয়ে ওঠে।’ অর্থাৎ মাল্টিটাস্কিং কার্যত মিথ। একসঙ্গে একাধিক কাজে পূর্ণ মনোসংযোগ করা কঠিন।
মুক্তবাজারে পণ্যের মূল্য নির্ধারিত হয় জোগান ও চাহিদার ভিত্তিতে। আর মনোযোগ অর্থনীতির মুদ্রাই হলো মানুষের মনোযোগ। যে মুদ্রা মূল্যবান, সীমিত এবং দুষ্প্রাপ্য। তবে শুরুতেই বলা হয়েছে, প্রযুক্তি যত এগোচ্ছে তথ্য প্রাপ্তিও তত সহজ হয়ে উঠছে। এই তথ্য এমন কৌশলে আমাদের সামনে উপস্থাপন করা হচ্ছে, যেন সহজে মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারে।
ফেসবুক-টুইটারের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কথা বলুন, আর নিত্যব্যবহারের নানান অ্যাপের কথাই বলুন, প্রতিনিয়ত নোটিফিকেশন পাঠিয়ে ব্যবহারকারীর মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করে যাচ্ছে। আর একবার অ্যাপে ঢুকলে যতক্ষণ পারা যায় ব্যবহারকারীকে আটকে রাখার নানান ফিচার যুক্ত করা হয়েছে। এ কারণেই ফেসবুকের ফিড দেখবেন কখনো ফুরোয় না। ইউটিউব-নেটফ্লিক্সে অটোপ্লে চালু থাকলে একের পর এক ভিডিও চলতেই থাকে। বিজ্ঞাপন বলুন, খবরে শিরোনাম বলুন, সবকিছুই চটকদার কিছুর মাধ্যমে আপনার মনোযোগ পেতে চায়।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর অ্যালগরিদম এমনভাবে সাজানো হয়েছে যেন আবেগ উদ্রেককারী পোস্ট বেশি থাকে। আপনি যেন চট করে অ্যাপ বন্ধ করে চলে না যান, তার সব ব্যবস্থা করা আছে। তার চেয়েও বড় কথা, ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রামের ব্যবহার মানুষের অভ্যাসে পরিণত করেছে। মাঝেমধ্যে দেখবেন, নিজের অজান্তেই ফেসবুকে ঢুকে বসে আছেন।
এতে সমস্যা কোথায়?
যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার আরভাইন ক্যাম্পাসের অধ্যাপক গ্লোরিয়া মার্ক দেখালেন, যখন নোটিফিকেশনের কারণে একবার কাজে ব্যাঘাত ঘটে, সেই মনোযোগ ফিরে পেতে সময় লাগে ২৩ মিনিট। আর মার্কিন নাগরিকরা গড়ে প্রতি চার মিনিটে একবার বা দিনে গড়ে ৩৪৪ বার ফোন ব্যবহার করেন। অন্যান্য দেশের অবস্থাও মোটামুটি এমনই। এর সমস্যা হলো, মানুষের জীবনযাপনের মান কমে যাচ্ছে। সময়গুলো যেভাবে উপভোগ করার কথা ছিল, কাজে লাগানোর কথা ছিল, সেভাবে হচ্ছে না।
আরেকটা ব্যাপার হলো, অ্যাটেনশন ইকোনমির মুদ্রা যদি মনোযোগ হয় তবে এই মুদ্রা আমাদের খেয়ালখুশিমতো খরচ করতে পারছি না। বরং ফেসবুক-টুইটারের মতো সেবাগুলো নির্ধারণ করছে মনোযোগ কোথায় ব্যয় করতে হবে। আর তার প্রয়োজনে মানুষের মধ্যে বিদ্বেষ ছড়িয়ে দিতেও দ্বিধা করছে না।