২০ বছরে লাগিয়েছেন ২০ লাখ গাছ
বড়জোর ১০০ দিন। এরই মধ্যে প্রায় ৮ লাখ মানুষ হত্যা করে চরমপন্থিরা। ১৯৯৪ সালের ভয়ংকর সেই ঘটনা ‘রুয়ান্ডা গণহত্যা’ নামে পরিচিত। ভয়াবহ ঘটনাপ্রবাহ ক্যামেরাবন্দী করতে ব্রাজিলের আলোকচিত্রী সেবাসচিয়াও রিবেইরো সালগাদোকে পাঠানো হয় সেখানে। মাঠে নেমে পড়লেন তিনি। ছবির মাধ্যমে তুলে ধরলেন দুঃসহ দিনগুলো।
এরপর একদিন গণহত্যা থামল। তবে দুঃসহ স্মৃতিরা থামল না। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে ফেলে সেবাসচিয়াওকে।
ভগ্নহৃদয়ে দেশে ফিরলেন। ব্রাজিলের মিনাস জিরাইসে। আশা করেছিলেন যে সবুজের কোলে তিনি বেড়ে উঠেছেন, সে সবুজের বুকেই ফিরবেন। কিন্তু চাইলেই কি আর সব পাওয়া যায়? (যায়। সে কথায় পরে আসছি।)
মিনাস জিরাইসে ফিরে সবুজ বনভূমির বদলে তিনি মাইলের পর মাইলে ধুধু রুক্ষ প্রান্তর পেলেন। বৃক্ষ নিধনের যাঁতাকলে পড়ে মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে শ্যামল বাসভূমি পরিণত হয়েছে পতিত জমিতে। সেবাসচিয়াওয়ের ভাষায়, ‘সবকিছু ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। ওই বন আমার মতোই অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। মাত্র ০.৫ শতাংশ জমিতে গাছ ছিল।’ দুঃখে ভেঙে পড়েন।
স্ত্রী চাইলেন পুনরায় বনানী গড়তে
এমন সময় তাঁর স্ত্রী লেলিয়া প্রায়-অসম্ভব এক প্রস্তাব দিয়ে বসলেন। পুরো বনভূমি গড়তে চাইলেন নিজ হাতে। স্ত্রীকে সমর্থন দেন সালগাদো। দুজনে মিলে নেমে পড়েন অসাধ্য সাধনে।
ব্রাজিলের আলোকচিত্রীর বন
পরিত্যক্ত এক খামারবাড়ি কিনেছিলেন সালগাদো। এরপর স্বেচ্ছাসেবক আর সহযোগীদের নেটওয়ার্ক গড়ায় মনোযোগ দিলেন দুজনে। একে তো অর্থ দরকার, স্বেচ্ছাশ্রম ছাড়াও এ কাজে সম্ভব না। ১৯৯৮ সালে সালগাদো দম্পতি প্রতিষ্ঠা করলেন ইনস্টিটুটো টেরা। এই সংগঠনটির অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলেই প্রাণ ফিরে পেয়েছিল সে বন।
১৯৯৯ সালের ডিসেম্বরে প্রথম বীজ বপন করেন সালগাদো। শুরুর দিকে ২৪ জন দিনমজুর নিয়োগ দেন। পরবর্তী বছরগুলোতে অসংখ্য স্বেচ্ছাসেবক হাত বাড়িয়ে দেন। আগাছা পরিষ্কার থেকে শুরু করে নতুন চারা রোপণ পর্যন্ত—রাতদিন কাজ করলেন সবাই মিলে। তাঁদের কঠোর পরিশ্রম বেশ দ্রুতই ফল দিতে শুরু করে। উপযুক্ত পরিবেশ পেয়ে ওই অঞ্চলের ট্রপিক্যাল গাছগুলো দ্রুত বাড়তে থাকে।
বিশ্বজুড়ে অন্যরকম খবরগুলো দেখুন
অনুদান হিসেবে পাওয়া এক লাখের বেশি গাছের চারা ঘন বনানী তৈরি করল। হাতেগড়া সে বনে তাঁরা মূলত স্থানীয় বৃক্ষ এবং কিছু লতা জাতীয় গাছ লাগিয়েছিলেন। স্যাটেলাইটে তোলা ছবিতে চোখ জুড়ানো দৃশ্য দেখা যায়। অথচ এখানেই এক সময় খাঁখাঁ করত।
১৯৯৮ সালের পর থেকে তাঁরা ১ হাজার ৫০২ একর জমিতে ২৯৩ প্রজাতির ২০ লাখ গাছের চারা রোপণ করেন। জীবনীশক্তিতে ভরপুর সে বনভূমিকে ব্যক্তি উদ্যোগে সৃষ্ট প্রাকৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণাগার হিসেবে ঘোষণা দেয় প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ—আইইউসিএন।
সালগাদোর বনভূমির প্রভাব
বিশ্বের অন্যতম সে বনায়ন প্রকল্প ভূমিধ্বস ঠেকিয়ে ওই এলাকাকে প্রাকৃতিকভাবে সমৃদ্ধ করেছে। এক সময়ের শুকিয়ে যাওয়া আটটি ঝর্ণা পূর্ণোদ্দমে পানির ফোয়ারা ছড়াচ্ছে এখন। এক সময় যা খরাপ্রবণ ছিল, এখন নতুন জীবনের হাতছানি দিচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা, জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে চারিদিকে যে হতাশা, সালগাদোদের প্রকল্প দেখিয়ে দিয়েছে, চাইলেই ঠেকিয়ে দেওয়া যায় যেকোনো দুর্যোগ। ওই বনাঞ্চলে বৃষ্টিপাত বেড়েছে, আবহাওয়াও শীতল হয়েছে।
আরও পড়ুন: মহাকাশে ঢেকুর তোলা যায় না কেন?
আনন্দের বিষয় হলো, যারা ঘরছাড়া হয়েছিল, তারা ফিরছে। বনের ভেতরে এখন পর্যন্ত ১৭২ প্রজাতির পাখি, ৩৩ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং ১৫ প্রজাতির উভচর প্রাণী ও সরীসৃপের অস্তিত্ব মিলেছে। দুই দশক আগে যা চিন্তাও করা যেত না। এই বনের অনেক প্রাণীই বিলুপ্তপ্রায়ের তালিকায় পাওয়া যাবে।
মানুষ চাইলে কী না পারে
জলবায়ু পরিবর্তন হলো নিষ্ঠুর বাস্তবতা। আমাদের বসবাসের এই গ্রহকে মানুষ অবিরত ধংসের দিকে ঠেলে দিয়েছে। আঘাতটা এসে পড়ছে সেই মানুষের ওপরই। তবে এখনো সালগাদো এবং লেলিয়ার মতো মানুষ আছেন বলেই ভরসা। ধৈর্য এবং অধ্যবসায়ের ফল চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন তাঁরা। বুঝিয়ে দিয়েছেন, প্রকৃতির ক্ষত কীভাবে সারাতে হয়। দুজন মানুষ যদি মাত্র ২০ বছরে ১৫০২ একর বনভূমি গড়ে তুলতে পারেন, একবার ভাবুন, সবাই এগিয়ে এলে আরও কী কী করা সম্ভব। একটা গাছ রোপণ করা মানে বায়ুমণ্ডলে বছরে ১১৮ কেজি অক্সিজেন সরবরাহ এবং ২২ কেজি কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃশেষ করা।
আরও পড়ুন: ফেসবুকে অনলাইনে থেকেও অফলাইন দেখাবেন যেভাবে
সুতরাং, সম্ভব হলে গাছ লাগান। নিজে ফল তো পাবেনই, সবাইকে সঙ্গে নিয়ে সবুজ পৃথিবীর পথে আরেক ধাপ এগিয়ে যাবেন।