গুহাবন্দি পনিরে টিকে থাকার লড়াই

 গুহাবন্দি পনিরে টিকে থাকার লড়াই

করোনাকালে লোরেতো পাসিত্তি তাঁর পেকোরিনো পনির গুহাবন্দি করা শুরু করেন। ছবি: ফাউস্তো কাসেরিও

ইতালির সেরা পনিরগুলোর একটি পেকোরিনো। চাহিদাও বেশ। অথচ লোরেতো পাসিত্তির পনিরগুলোর কোনো গতি হচ্ছিল না। একে তো রেস্তোরাঁ খোলা নেই, তার ওপর বাড়তি উৎপাদন ব্যয় আর গ্রাহকদের খরচ কাটছাঁটে লোরেতোর কপালের ভাঁজ বাড়ে বৈ কমে না।

এই ঘটনা করোনাকালীন। লোরেতোর দশা ইতালির সব পেকোরিনো উৎপাদকের। পুরো শিল্প হুমকির মুখে। লোরেতো দেখলেন সামনে একটাই খোলা পথ। শত শত বছর আগে পূর্বসূরিরা যা করতেন, তিনিও তা-ই করলেন। গুহায় বন্দি করেন সব পনির।

ইতালির লাজিওর পিসিনিস্কো গ্রামে লোরেতোর পনিরের দোকান। নাম লা কাসিওস্তেরিয়া দি কাসা লরেন্স। বিবিসিকে তিনি বলেন, ‘লকডাউনের সময় আমার প্রায় সবকিছু শেষ হয়ে যায়। তবে পনির মাটির নিচে রাখার এই প্রাচীন পদ্ধতির কারণে সব ফিরে পাই।’

লরেতোর পনিরের কারখানা লা কাসিওস্তেরিয়া দি কাসা লরেন্সের কর্মীরা যেন একেকজন পুরোদস্তুর শিল্পী। ছবি: মারিনা পাসকুচি
লরেতোর পনিরের কারখানা লা কাসিওস্তেরিয়া দি কাসা লরেন্সের কর্মীরা যেন একেকজন পুরোদস্তুর শিল্পী। ছবি: মারিনা পাসকুচি

ভেড়ার দুধ থেকে তৈরি নোনতা স্বাদের পেকোরিনো নানাভাবে বাজারে আসে। পরিবেশনেও ভিন্নতা আছে। একটি সংস্করণ তৈরি হয় রাজধানী রোমের উপকণ্ঠের লাজিও অঞ্চলে। ‘পেকোরিনো রোমানো’ নামের সে পনিরের ব্যবহার ইতালিজুড়ে। নানা পদের খাবারে ব্যবহারও বেশ।

ইতালিতে দুই হাজার বছর ধরে তৈরি হচ্ছে পেকোরিনো রোমানো। দীর্ঘদিন রাখা যায় বলে রোমান সেনাদের খাবার হিসেবে উপযুক্ত ছিল। লবণ দিয়ে স্থায়িত্ব আরও বাড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু হয় মধ্যযুগে।

রোমান সাম্রাজ্যের পতন হলেও টিকে যায় পেকোরিনো রোমানো। করোনার ধাক্কাও সামলে ওঠে সহজেই। কারণ পেকোরিনোর অন্য ধরনগুলোর তুলনায় বাড়িতে এর ব্যবহার বেশি। ২০২০ সালে লকডাউন শুরু হলে পরিবারগুলো বরং মজুত করতে শুরু করে।

বিশ্বজুড়ে অন্যরকম খবরগুলো দেখুন
ইতালির এক পনির বিক্রেতা। ছবি: মারিনা পাসকুচি
ইতালির এক পনির বিক্রেতা। ছবি: মারিনা পাসকুচি

বিপদে পড়েন অন্যান্য পেকোরিনো বিক্রেতারা। লোরেতো পাসিত্তি বলেন, ‘করোনার সময় আমি মানুষের ঘরে ঘরে গিয়ে বিক্রির চেষ্টা করেছি। অনলাইনে স্টোর খুলেছি। কাজের কাজ কিছু হয়নি। এরপর উৎপাদনের ধারা বদলে দিলাম।’

২০২০ সালের জুলাইয়ে আকারে বড় পনির বানাতে শুরু করেন লোরেতো, যেন একসঙ্গে অনেক পনির সংরক্ষণ করতে পারেন। এরপর সেগুলো মধ্য ইতালির এমিলিয়া-রোমানিয়ায় চার মিটার গভীর এক চুনাপাথরের গুহায় সংরক্ষণ করা শুরু করেন।

ভূগর্ভে খাবার সংরক্ষণের প্রাচীন এই কৌশলের নাম ফোসা। এতে সময়ের সঙ্গে পনির আরও উন্নত হয়। একই পদ্ধতিতে পনির সংরক্ষণ করেন রোমের রেস্তোরাঁমালিক মাসিমো ইনোসেন্তি। তার রেস্তোরাঁর মেঝের নিচ দিয়ে চলে গেছে দুই হাজার বছরের পুরোনো এক গুহা। সেই রোমান সাম্রাজ্যের আমলের। সেখানেই পেকোরিনো সংরক্ষণ করেন তিনি।

আরও পড়ুন: নভোচারীদের ব্যাকপেইন বেশি হয় কেন
মাসিমো ইনোসেন্তির রেস্তোরাঁর নিচ দিয়ে দুই হাজার বছর পুরোনো গুহা চলে গেছে। ছবি: মারিনা পাসকুচি
মাসিমো ইনোসেন্তির রেস্তোরাঁর নিচ দিয়ে দুই হাজার বছর পুরোনো গুহা চলে গেছে। ছবি: মারিনা পাসকুচি

ইনোসেন্তির রেস্তোরাঁর হেঁশেল সামলান বাংলাদেশের শাহিন গাজী। দেশে মায়ের কাছে প্রথম সি ফুড তৈরি শেখেন তিনি। ২০১০ সালে নেচ্যিতে যান শাহিন। বিবিসিকে তিনি বলেন, ‘আমি পেকোরিনোর ভক্ত। প্রখর স্বাদের অন্যান্য উপকরণের সঙ্গে বেশ যায় এটি। সে কারণে রোমান রসনার জন্য একদম পারফেক্ট।’

লোরেতো পাসিত্তি পনির সংরক্ষণের জন্য গুহা পূর্ণ করে তিন মাসের জন্য বন্ধ করে দেন। এতে পনির অক্সিজেন শুষে নেয়ার সময় পায়, তা ছাড়া পরিপক্ব হলে স্বাদ-গন্ধও বাড়ে। স্বাভাবিকভাবে পনির পাঁচ থেকে ছয় মাস সংরক্ষণ করা গেলেও এই প্রক্রিয়ায় তা ১৮ থেকে ২৪ মাস পর্যন্ত হয়ে থাকে।

আরও পড়ুন: বয়স্করা হাল আমলের গান পছন্দ করেন না কেন

পনিরের কাঁচামালেও করোনার ধাক্কা লেগেছে। লোরেতোর দোকানের অদূরেই সেতেফ্রাতি। সেখানে ৯ পুরুষ ধরে মেষ পালন করেন মারিয়া পিয়া ও তার ভাই আন্তোনিওর পরিবার। প্রত্যেক জুনে ভেড়ার পাল নিয়ে ১৭ কিলোমিটার দূরের এক সমতল ভূমিতে যান তারা। এই ভেড়ার দুধ থেকে তৈরি পেকোরিনো পনিরেই তাদের পারিবারিক ব্যবসা চলে। তবে প্রাণিখাদ্য আর জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিতে হিমশিম খেতে শুরু করেন তারা।

ইতালিতে নানা ধরনের খাবারে পেকোরিনো পনির ব্যবহারের চল আছে। ছবি: মারিনা পাসকুচি
ইতালিতে নানা ধরনের খাবারে পেকোরিনো পনির ব্যবহারের চল আছে। ছবি: মারিনা পাসকুচি

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি মোকাবিলায় ভুট্টা উৎপাদন শুরু করে পিয়া পরিবার। বছরে উৎপাদন ১২ হাজার কেজি হলে প্রতি ১০০ কেজিতে ২০ ইউরো বাচে তাদের। ব্যয়সংকোচনে এমন অনেক কৌশল অবলম্বন করতে হয় তাদের।

করোনার সময় জ্বালানিব্যয় লিটারপ্রতি আধা ইউরো থেকে বেড়ে ১ দশমিক ৩০ ইউরোতে ওঠে। সার্বিক খরচ ৬০ শতাংশ বেড়ে যায়। অথচ পনিরের দাম বড়জোর ১০ শতাংশ বাড়াতে পেরেছেন বিক্রেতারা, তা-ও বিক্রি কমেছে ২৫ শতাংশ। বিশেষ করে মানুষের আয় কমে যাওয়ায় কেজিপ্রতি ৪০ ইউরোর পেকোরিনো কেনার লোক পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। অনলাইন কিংবা ঘরে ঘরে গিয়ে বিক্রির চেষ্টা না করলে অবস্থা আরও খারাপ হতো।

আরও পড়ুন: চলচ্চিত্রে খলনায়কের হাতে কখনো আইফোন থাকে না কেন

আরও পড়ুন

মন্তব্য করুন

Your email address will not be published.