মেটাভার্স কি আসলেই ফেসবুকের ভবিষ্যৎ?
![মেটাভার্স কি আসলেই ফেসবুকের ভবিষ্যৎ?](https://www.thewindowshow.com/wp-content/uploads/2023/02/zuck-metaverse-850x560.jpg)
মার্ক জাকারবার্গ সশরীর উপস্থিত, অন্যজন যোগ দিয়েছেন দূরে কোথাও থেকে, অথচ দিব্যি তাঁরা ফেন্সিংয়ের মতো খেলায় অংশ নিয়েছেন। ছবি: মেটা
‘মেটাভার্স’ শব্দটি ইদানীং প্রায়ই শোনা যাচ্ছে। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের মূল প্রতিষ্ঠানের নাম বদলে ‘মেটা’ করার পর থেকে। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মার্ক জাকারবার্গ নিজেই বলছেন, ফেসবুকসহ তাঁর প্রতিষ্ঠানের অন্যান্য সেবার ভবিষ্যৎ হলো মেটাভার্স। এককথায় সেটাকে আমরা ভার্চ্যুয়াল দুনিয়া বলছি। তবে মেটাভার্স আসলে কী? কাজই–বা করে কীভাবে?
মেটাভার্স আসলে কী?
মেটাভার্সের ধারণা বেশ বড়। রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সেটি এমন ত্রিমাত্রিক ভার্চ্যুয়াল দুনিয়া, যেখানে অনেক মানুষ একসঙ্গে ইন্টারনেটের মাধ্যমে যুক্ত হতে পারেন। তবে ভার্চ্যুয়াল দুনিয়ায় তো আর সশরীর উপস্থিত হওয়ার সুযোগ নেই। তাই প্রত্যেকের ত্রিমাত্রিক আভাটার বা অবতার থাকবে। অনেকটা কার্টুন চরিত্রের মতো।
সে চরিত্র নিয়ন্ত্রণ করবেন আপনি, মানে ব্যবহারকারী। আপনি হাসলে, চরিত্র হাসবে, কথা বললে চরিত্রও তা-ই করবে, হেঁটে গেলে চরিত্রও এগোবে। অর্থাৎ মেটাভার্সের দুনিয়ায় চলবেন-ফিরবেন, কারও সঙ্গে দেখা হলে কথা বলবেন, সুখ–দুঃখের গল্প করবেন এবং ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমে করা যায়, এমন কাজও করবেন অন্যদের সঙ্গে। এই ‘অন্যদের’ পেছনে আছেন বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে যুক্ত হওয়া অন্যান্য মানুষ। অর্থাৎ আসল মানুষদের সঙ্গে কথোপকথন হবে, কেবল ভার্চ্যুয়াল জগতে।
আর তা সম্ভব হবে ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটি (ভিআর) এবং অগমেনটেড রিয়েলিটি (এআর) প্রযুক্তির সাহায্যে। দুটি ক্ষেত্রেই হেডসেট পরতে হয়। তবে ভিআরের ক্ষেত্রে চোখে হেডসেট থাকলে আপনি পুরোপুরি ভিন্ন ভার্চ্যুয়াল জগতে প্রবেশ করবেন, যেখানে সবকিছুই ভার্চ্যুয়াল। এআর প্রযুক্তিতে বাস্তব দুনিয়ায় পরাবাস্তব উপাদান দেখা যায়।
মনে করুন আপনি চেয়ারে বসে টেবিলে ল্যাপটপ রেখে কাজ করছেন, পাশের চেয়ার খালি। এআর গ্লাস পরে আপনি আপনার চেয়ার-টেবিল-ল্যাপটপ, বাস্তব দুনিয়ার সবকিছুই দেখতে পাবেন। তবে পাশের খালি চেয়ারে হয়তো কানাডায় থাকা কোনো বন্ধুকে চট করে এসে বসতে দেখলেন, তাঁর সঙ্গে কাজের আলাপ করলেন। চোখ থেকে চশমা খুললেই তিনি মিলিয়ে যাবেন। এই হলো এআর ও ভিআরের সাধারণ ধারণা।
![দুই দাবাড়ু খেলছেন দাবা, একজন চোখে এআর গ্লাস লাগিয়ে সশরীর উপস্থিত, অপরজন যোগ দিয়েছেন দূরে কোথাও থেকে। ছবি: মেটা](https://www.thewindowshow.com/wp-content/uploads/2023/02/eGaming_1-1-1024x576.jpg)
এমন আরও এক্সপ্লেইনার পড়ুন এখানে
যাঁরা মাল্টিপ্লেয়ার অনলাইন রোল-প্লেয়িং গেমের সঙ্গে যুক্ত, তাঁরা এরই মধ্যে মেটাভার্সের স্বাদ পেয়েছেন। এ ধরনের গেমে অনেক ব্যবহারকারী একসঙ্গে কোনো ভার্চ্যুয়াল জগতে অভিযানে নামেন। প্রতিটি গেমের কোনো না কোনো চরিত্র নিয়ন্ত্রণ করেন। হেঁটে বেড়ান, অন্য গেমারদের সঙ্গে আলোচনা করেন ইত্যাদি।
আরেক ধরনের মেটাভার্স আছে, যা ব্লকচেইন প্রযুক্তির সাহায্যে পরিচালিত হয়। সেখানে ব্যবহারকারীরা ক্রিপ্টোকারেন্সির বিনিময়ে ভার্চ্যুয়াল জমি কিংবা অন্যান্য ডিজিটাল সম্পত্তি কিনতে পারেন।
বিজ্ঞান কল্পকাহিনিতেও মেটাভার্সের উল্লেখ পাওয়া যায়। সেটা উপন্যাসে হোক কিংবা চলচ্চিত্রে। প্লটের পুরোটা কিংবা আংশিক থাকে ডিজিটাল জগতে। আর ‘মেটাভার্স’-এর উল্লেখ প্রথম উপন্যাসেই করা হয়। ১৯৯২ সালে প্রকাশিত মার্কিন লেখক নিল স্টিফেনসনের লেখা ‘স্নো ক্র্যাশ’ উপন্যাসে বাস্তব দুনিয়া ধ্বংসের মুখে পৌঁছে গেলে মানুষ নিজ নিজ ডিভাইস থেকে ভার্চ্যুয়াল এক জগতে প্রবেশ করে।
চলচ্চিত্রে অবশ্য সে জগতের সঙ্গে বাস্তবের দুনিয়ার ফারাক করা কঠিন হয়ে পড়ে। তবে বর্তমানে যে ভার্চ্যুয়াল জগৎগুলো আমরা এ পর্যন্ত দেখেছি, সেগুলো এখনো গেমের মতোই আছে, বাস্তব দুনিয়ার মতো হয়ে ওঠেনি।
![মেটাভার্সে একসঙ্গে যেভাবে ব্যায়ামে অংশ নেওয়া যাবে। ছবি: মেটা](https://www.thewindowshow.com/wp-content/uploads/2023/02/eFitness_3-1-1024x576.jpg)
হঠাৎ সবাই মেটাভার্সে আগ্রহী হয়ে উঠল কেন?
মেটাভার্সকে অনেকে ইন্টারনেট বিবর্তনের পরবর্তী ধাপ হিসেবে উল্লেখ করছেন। এখন ফেসবুকে যেমন হয়, যোগাযোগ রক্ষার জন্য সবাই একই ওয়েবসাইট বা অ্যাপে ঢুকে থাকেন। মেটাভার্সেও একটি ‘কমন স্পেস’ থাকবে। সেখানে কেবল যে অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাবে, তা-ই না, ব্যবহারকারী ডিজিটাল কনটেন্টের মধ্যেই থাকবেন। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক।
আরও পড়ুন: বয়স্করা হাল আমলের গান পছন্দ করেন না কেন
মনে করুন আপনি কোনো বিপণিবিতানে সশরীর গিয়ে এখন যেমন দুটি কাপড় উল্টেপাল্টে, তাক থেকে তিনটি ফেলে দিয়ে, চারটি ট্রায়াল করার পর কোনোটি না কিনে বেরিয়ে আসেন। আচ্ছা, ধরে নিচ্ছি একটা জামা আপনি কিনেছেন। মেটাভার্সে হলে আপনি এই পুরো অভিজ্ঞতাটাই পাবেন ভার্চ্যুয়াল জগতে।
আপনার অবতার ভার্চ্যুয়াল বিপণিবিতানজুড়ে ঘুরে বেড়িয়ে, তাক থেকে কাপড় নিয়ে গায়ে চড়িয়ে ডিসপ্লেতে দেখে নিতে পারে কেমন লাগছে, এরপর ফরমাশ জানিয়ে বেরিয়ে এলেন। পরদিন সেটি আপনার বাসায় দিয়ে গেল। আবার ওই ভার্চ্যুয়াল দোকানে ঢোকার আগে তিন বন্ধুকেও ঢুকতে বলতে পারেন। যে যার বাসা থেকে ভার্চ্যুয়াল দোকানে ঢুকে একসঙ্গে কেনাকাটা সেরে বেরিয়ে যাবে।
আবার মনে করুন, আপনি সুন্দরবনে গিয়ে বাঘের দেখা পেলেন। ছবি তুললেন, ভিডিও করলেন এবং ধরে নিচ্ছি মামা হওয়ার খাতিরে বাঘ আপনাকে কিছু করেনি। যেগুলো এখন আপনি ফেসবুকে পোস্ট করতে পারেন। আর মেটাভার্সে ওই পরিবেশ পুনরায় ত্রিমাত্রিক রূপে তৈরি করা সম্ভব। এরপর বন্ধুরা ভার্চ্যুয়াল সুন্দরবনে বেড়ানোর পাশাপাশি ভার্চ্যুয়াল মামার সাক্ষাৎও পেতে পারে।
![ভার্চ্যুয়াল কনসার্ট আয়োজন শুরু করেছেন অনেক শিল্পী। ছবি: মেটা](https://www.thewindowshow.com/wp-content/uploads/2023/02/eEntertainment_1-1-1024x576.jpg)
করোনাকালে সবাই যখন নিজ নিজ ঘর থেকে অনলাইনে কাজ করতে শুরু করেন, তখন মেটাভার্সের প্রয়োজনীয়তা বাড়তে থাকে। কারণ, কাজ আপনি ঘর থেকে করতে পারেন, তবে ঘরে থেকে বেড়াতে যাবেন কীভাবে? অনলাইন দুনিয়াকে আরও কিছুটা জীবন্ত করার চেষ্টা বলা যেতে পারে এই মেটাভার্স।
আরও পড়ুন: নভোচারীদের ব্যাকপেইন বেশি হয় কেন
মেটাভার্স নিয়ে কি কেবল ফেসবুকই (মেটা) কাজ করছে?
ফেসবুকের সিইও মার্ক জাকারবার্গ গত জুলাইয়ে বলেন, তাঁর প্রতিষ্ঠান বর্তমানের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে মেটাভার্সে রূপ নেবে।
মেটাভার্স শব্দটি সিলিকন ভ্যালিতে এখন এমনিতেই বেশ জনপ্রিয়। বেশি উচ্চবাচ্য না করলেও মাইক্রোসফট দীর্ঘদিন ধরে এ নিয়ে কাজ করছে। বিশেষ করে ভার্চ্যুয়াল আর বাস্তব দুনিয়াকে এক করে দেখানোয় বেশি আগ্রহী তারা।
ছোটদের জনপ্রিয় গেম রবলক্সও নিজেদের মেটাভার্স প্রতিষ্ঠান হিসেবে উল্লেখ করে থাকে। গেম প্রকাশক প্রতিষ্ঠান এপিক গেমসের ফোর্টনাইটকেও মেটাভার্স হিসেবেই ধরা হয়।
সংগীতশিল্পীরা মেটাভার্সে ভার্চ্যুয়াল কনসার্টের আয়োজন করতে পারেন। এর মধ্যে করেছেনও। যেমন গত সেপ্টেম্বরে ফোর্টনাইট গেমে আয়োজিত আরিয়ানা গ্র্যান্ডের ভার্চ্যুয়াল কনসার্ট দেখেছেন লাখ লাখ দর্শক।
তখন ফেসবুক কি আমার আরও ব্যক্তিগত তথ্য নেবে?
সে আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ কম। মেটাভার্স নিয়ে জাকারবার্গ যে স্বপ্ন দেখছেন, তা ধারণাটির মূলনীতির সঙ্গে কিছুটা সাংঘর্ষিক। মেটাভার্সকে পার্থিব দুনিয়া থেকে দূরের কোনো ‘মুক্তি’র জগৎ হিসেবে দেখা হতো। যেখানে প্রত্যেকে নাম–পরিচয় গোপন রেখে স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াবেন।
এদিকে জাকারবার্গ নিজেই বলেছেন, মেটাভার্সেও তাঁদের ব্যবসায়িক মডেল অটুট থাকবে। সে ব্যবসা ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্য ব্যবহার করে বিজ্ঞাপন দেখানোর। সর্বশেষ আর্থিক প্রতিবেদন পেশ করার সময় বিনিয়োগকারীদের তিনি বলেছিলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হিসেবে আমরা যা করছি, তাতে বিজ্ঞাপন বেশ গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হিসেবেই থাকছে, এবং সম্ভবত মেটাভার্সেও তা বেশ অর্থপূর্ণই থাকবে।’
আরও পড়ুন: কিছু লেন্স সাদা, কিছু লেন্স কালো হয় কেন?